সম্ভবামি যুগে যুগে

নিশুতি রাত। আঁধারের কম্বলে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে শহর। একটা আলোরও দেখা মেলেনা কোথাও। রাস্তার বাতি টিমটিম করে জ্বলতে জ্বলতে নিভে গেছে কবে কে জানে! ঠান্ডা হয়ে আসা উনুনের সরু একফালি সাদা ধোঁয়া পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে উঠছে ওপরে, আকাশের তারাদের সঙ্গে মিশে যাবে বলে। নিঃস্তব্ধ নিঃঝুম চারিদিক। শুধু কয়েকটা কুকুরের চিৎকারে মাঝে মাঝে রাত্রির জমাট বাঁধা স্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে।

এই শব্দহীন রাতে হঠাৎ শোনা গেল তাঁর পদধ্বনি। তিনি যে আসবেন আগাম জানতনা কেউ। তবু তাঁর পদশব্দ শুনতে পেল সবাই। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর দিনের শেষে শ্রান্ত দেহে ছেঁড়া কাঁথা মুড়ি দিয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা মজুর — সেও শুনতে পেল। তার ভাঙা ঘরের দরজাটা নড়ে নড়ে উঠে জানান দিল তাকে। পদধ্বনি কানে গেল গল্প শুনতে শুনতে মায়ের বুকে মাথা দিয়ে ঘুমে এলিয়ে পড়া শিশুর। প্রাসাদের দরজায় দাঁড়িয়ে ঝিমোতে থাকা নৈশপ্রহরী আধো তন্দ্রায় অনুভব করল তাঁর আগমনের বার্তা।‍ প্রাসাদের এক অন্ধকার কোণে চটা কম্বলে কোনরকমে গা ঢেকে ঘুমিয়ে ছিল যে দাসী, সেই অদ্ভুত পায়ের শব্দে চমকে জেগে উঠল সে-ও। পথে ঘুমিয়ে থাকা গৃহহীন উদ্বাস্তু লাখ টাকার স্বপ্ন দেখতে দেখতে শুনতে পেল সে পদধ্বনি, যেন সে স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে এখনি।

Continue reading

মধুসিংহের পদাবলী

সাধু ভাষায় লিখিতেছি, পাঠক ত্রুটি মার্জনা করিবেন। কিন্তু যে গুরুগম্ভীর বিষয়ের আলোচনা করিতে চলিয়াছি আজ, চলিত ভাষার প্রকাশক্ষমতা তাহার জন্য নিতান্তই অপ্রতুল।

সম্প্রতি সঙ্গীতের মহাকাশে ধূমকেতুর ন্যায় এক যুগপুরুষের আবির্ভাব হইয়াছে। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, গায়ক এবং নৃত্যশিল্পী। এই যুগপুরুষ সাধারণের নিকট লাট্টু মধুসিংহ নামে পরিচিত। তাঁহার রচিত গীতিসমূহ ‘মধুসিংহের পদাবলী’ নামে খ্যাত।

নামের পূর্বভাগে তিনি লাট্টু শব্দটি কেন ব্যবহার করিয়া থাকেন, তাহা আমাদের বুদ্ধির অগম্য। মহাপুরুষের ক্রিয়াকলাপ — তাহার গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করার আশা করা আমাদিগের ন্যায় অর্বাচীন অপোগন্ডের পক্ষে বাতুলতার সমতুল্য। তবু অনুমান করার একটি অক্ষম প্রচেষ্টা করিতেছি। তাঁহার রচিত পদাবলীর বিষয় বস্তু কিঞ্চিৎ আদিরসাত্মক, এবং বয়ঃসন্ধি উত্তীর্ণ তরুণ তরুণীরাই তাঁহার পদাবলীর প্রধান শ্রোতা। সম্ভবতঃ কিশোর কিশোরীদের মনে প্রভাব বিস্তারের বাসনাই তাঁহার লাট্টু নাম ধারণের কারণ। তাহাই যদি মূল হেতু হইয়া থাকে, তবে স্বীকার করিতে হয় যে তাঁহার সে প্রচেষ্টা বহুলাংশে সফল হইয়াছে। স্পষ্টই দেখিতে পাইতেছি, দিকে দিকে বালক বালিকাবৃন্দ তাঁহার পদাবলীর আদিরসে সম্পৃক্ত হইয়া উদ্বাহু হইয়া নৃত্য করিতেছে ও তাঁহার জয়গান আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হইতেছে। কেবলমাত্র তরুণ তরুণী বা বালক বালিকা নহে, উক্ত বালক বালিকাদের পিতামাতাও মধুসিংহের বন্দনায় রত। জনমানসে তাঁহার প্রভাব অবিসংবাদিত। ইহার পূর্বে অন্য কোন চারণকবি মধুসিংহের ন্যায় প্রভাব বিস্তার করিতে সক্ষম হইয়াছেন বলিয়া আমরা বিশ্বাস করিনা।

Continue reading

চরৈবেতি! — ৩

।। দ্বিতীয় দিন ।।

সাত নম্বর চেক পয়েন্টে পৌছে সবাই কিছুক্ষণের জন্য বডি ফেলে দিল। কুন্ডলী পাকিয়ে একই মাদুরে চারজন লম্বা হল। তখন বেশ শীত, সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে হু হু করে। কিন্তু সবাই পায়ের ব্যথা আর ক্লান্তিতে জেরবার। ঠান্ডার দিকে ভ্রূক্ষেপ করার অবস্থা নেই কারো। শুশ্রুষা চলল শ্রীমতীর জখম পায়ের। কিছুটা স্ট্রেচিং করার পর মনে হল অবস্থাটা অপেক্ষাকৃত ভাল হল। অন্তত উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা চলা করতে পারছিলেন। এখানে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে ভোর চারটে নাগাদ বেরোবার প্ল্যান হল। আমার ইচ্ছে ছিল বাকি রাতটাও ওদের সঙ্গে চলা। কিন্তু উপায় নেই। সেই ছেলে দুটি — মানে যারা ব্যাঙ্গালোর থেকে বিরিয়ানি নিয়ে এসেছিল আর ছ’নম্বর চেক পয়েন্ট থেকে আমার গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে এসেছে — তাদের এবার ফিরতেই হবে। অগত্যা আমাকেই গাড়ি চালাতে হবে।

মাদুরের ওপর কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুম।

মাদুরের ওপর কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুম।

Continue reading

চরৈবেতি! — ২

এই ব্লগের প্রথম কিস্তিটা আগে পোস্ট করেছি।

।। প্রথম দিন ।।

দেখতে দেখতে ইভেন্টের দিনটা এসে হাজির — ২৪শে জানুয়ারি। যাত্রা শুরু ভোর ছ’টায়। ব্যাঙ্গালোরের দক্ষিণে আনেকাল পার্ল ভ্যালি বলে একটা জায়গা আছে। সেখান থেকেই ট্রেলওয়াক শুরু। রুট ম্যাপটা এই লিঙ্কে দেখতে পাবেন। ভোর ‍চারটেয় দুরু দুরু বক্ষে বেরোলাম বাড়ি থেকে। স্টার্টিং পয়েন্টে পৌঁছে দেখি একেবারে রথের মেলা বসে গেছে। দুশো টিম অংশগ্রহণ করছে, বিভিন্ন কোম্পানি থেকে। তার মানে প্রায় আটশো প্রতিযোগী, আর অন্ততঃ পাঁচশো সাপোর্ট ক্রু মেম্বার। এছাড়া উদ্যোক্তা কমিটির লোকজন তো আছেই। সব মিলিয়ে একেবারে জমজমাট (এবং গাড়ির ভিড়ে জ্যাম জমাট) অবস্থা।

ট্রেলওয়াকার শুরু হতে আর মিনিট চারেক বাকি!

যাত্রা হল শুরু — আর মিনিট চারেক মাত্র বাকি।

Continue reading

চরৈবেতি! — ১

।। ভূমিকা ।।

এর আগে একটি পোস্টে উল্লেখ করেছিলাম যে শ্রীমতী ভেতোবাঙালি একটা বিরাট ইভেন্টে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি হিসেবে ভয়ঙ্কর ফিটনেস রেজিম চালু করেছেন। সেই দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে আদাজল খেয়ে এক্সারসাইজ করতে লেগেছি। সেই বিরাট ইভেন্টটির সম্বন্ধেই বলতে চলেছি এই পোস্টে।

অক্সফ্যাম বলে বহুজাতিক NGO আছে। সংস্থাটি বেশ পুরোন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এদের উপস্থিতি। প্রধান উদ্দেশ্য দারিদ্র্য দূরীকরণ। এইসব NGO দের আমি চিরকাল কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখে থাকি। মনে হয় এগুলো সব শান্তিনিকেতনি ঝোলাধারী ‘কলচরড’ জনতার আড্ডা। আমাদের মত পাতি বুর্জোয়ারা সেখানে ব্রাত্য। এই অক্সফ্যাম সম্বন্ধেও নিন্দুকে বলে যে যত টাকা এরা জোগাড় করে, তার কুড়ি-তিরিশ শতাংশই চলে যায় নিজেদের পেট ভরাতে। তবে নিন্দুকে তো কত কথাই বলে। তাতে কান পাতলে চলবে?

অক্সফ্যামের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে যে এরা টাকা তোলার জন্য পৃথিবীর নানা দেশে ’ট্রেলওয়াকার’ বলে একটি ইভেন্টের আয়োজন করে। ভারতে হয় দু জায়গায় — মুম্বই আর বেঙ্গালুরু। এই ট্রেলওয়াকার শুরু হয়েছিল ১৯৮১ সালে, হংকং-এ — ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর গুর্খা রেজিমেন্টের জন্য। ইতিহাস চাইলে এই লিঙ্কে পড়ে নিতে পারেন। ইভেন্টের নিয়মকানুন মোটামুটি এরকমঃ

১) অংশগ্রহণ করতে চার জনের একটা দল গড়তে হবে।

২) চার জনের দলকে ইভেন্টের দুদিন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ১০০ কিলোমিটার হাঁটতে বা দৌড়তে হবে একটা নির্দিষ্ট পথে। পথ বলতে ম্যারাথন দৌড়ের ট্র্যাক নয়। মেঠো পথ, পাহাড়ি পাকদন্ডী, পিচের রাস্তা — সবই থাকে সে পথে। সাধারণতঃ গ্রাম-গঞ্জের ভেতর দিয়ে যায় সে রাস্তা — শহরে ঢোকেনা।

৩) সেই নির্দিষ্ট পথে ন’টা ‘চেকপয়েন্ট’ থাকবে — যেখানে খাবার, জল বিশ্রাম ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে। প্রত্যেকটা চেক পয়েন্টে দলের চারজনকে এক সঙ্গে ঢুকতে আর বেরোতে হবে। তার মানে এই দাঁড়ায় যে চারজনেরই হাঁটার বা দৌড়বার গতি মোটামুটি এক (বা অন্তত কাছাকাছি) হতে হবে।

৪) ৪৮ ঘন্টার মধ্যে চারজন এক সঙ্গে ১০০ কিলোমিটার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করলে মিলবে মেডেল আর শংসাপত্র।

Continue reading

জুলে! — ৪

এই ভ্রমণকাহিনির তিনটে কিস্তি আগে পোস্ট করেছি। লিঙ্ক গুলো দিলাম — প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় কিস্তি।

।। ১লা জুলাই — সারচু থেকে লেহ ।।

সেদিন রাত্রে ভাল ঘুম হলনা, কিন্তু বাঁচোয়া যে মাথাব্যথা হয়নি। তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে দেখি চারদিক রোদে ঝলমল করছে। চারপাশের পাহাড়ের সারি নানা রঙে সেজে উঠেছে। সত্যি, পাথরের যে এত বিচিত্র রঙ হতে পারে, বা এত ঊষর প্রকৃতি যে এত নয়নাভিরাম হতে পারে, সেটা এই লাদাখ যাত্রা না করলে কোনদিন স্বচক্ষে দেখা হত না। যে ছেলেগুলোর সঙ্গে কাল এখানে এসেছিলাম, তাদের একজনের অবস্থা বেশ খারাপ, mountain sickness এর শিকার হয়েছে। ওরা তাড়াহুড়ো করে ভোর ভোর বেরিয়ে গেল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেহ পৌঁছতে চায়।

সারচুর দৃশ‍্য। সারাপ-চু নদীর খাত। পেছনে সার দিয়ে সোনা রঙা পাহাড়ের সারি।

সারচুর দৃশ‍্য। সারাপ-চু নদীর খাত। পেছনে সার দিয়ে সোনা রঙা পাহাড়ের সারি।

সারচুতে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি ক‍্যাম্পের পাশের ছোট নালাটার জল জমে বরফ হয়ে রয়েছে। সূর্যের আলো ঝিকমিক করছে সেই বরফের ওপর পড়ে।

সারচুতে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি ক‍্যাম্পের পাশের ছোট নালাটার জল জমে বরফ হয়ে রয়েছে। সূর্যের আলো ঝিকমিক করছে সেই বরফের ওপর পড়ে।

জুতোর অবস্থা কাল যা ছিল তার থেকে কিছুমাত্র উন্নতি হয়েছে বলে মনে হলনা। ভিজে এখনো একসা। কাল ঘন্টা তিনেক হয়ত ভিজে জুতো পরে ছিলাম। নিউমোনিয়ায় ধরেনি, সে আমাদের ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষের সৌভাগ্য। কিন্ত বেড়ালের ভাগ্যে বার বার শিকে ছেঁড়েনা। আজও সারাদিন ওই জুতো পরে থাকলে নিউমোনিয়ার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা। তাছাড়া আজও যে রাস্তায় জুতো ভিজবেনা, তার নিশ্চয়তা কি? মনে হল, জুতোর জায়গায় রবারের গামবুট পরে আসলে ভাল হত। ভিজে যাওয়ার ভয় থাকতনা। নির্ভয়ে নদী-নালা পেরোন যেত। সমস্যার বেশ মোক্ষম সমাধান বার করা হল — মোজার ওপর প্ল‍্যাস্টিকের প্যাকেট বেঁধে, তার ওপর জুতো পরা। বরাতজোরে সঙ্গে কয়েকটা বাড়তি প্ল‍্যাস্টিক ছিল। আমি আবার প্যাকেট গুলো রেনকোটের প্যান্টের ওপর দিয়ে বেঁধে দিলাম, যাতে ওপর থেকেও জল ঢুকতে না পারে। দুপায়ের প্ল‍্যাস্টিকের রঙ দুরকম!

Continue reading

জুলে! — ৩

মোটরবাইকে লাদাখ ভ্রমণের দুটো কিস্তি আগেই পোস্ট করেছি — প্রথম আর দ্বিতীয় কিস্তির লিঙ্ক দিলাম। না পড়ে থাকলে চট করে পড়ে নিন! 🙂

।। ৩০শে জুন — ভয়ঙ্কর বারালাচা-লা ।।

পরদিন গড়িমসি করতে করতে বেরোলাম ন’টা নাগাদ। দেরি করার একটা কারণও ছিল — আগের দিন মেকানিক খঁুজে পাইনি, আজ সকালে গ্যারাজ খুললে জয়ের বাইকটা চেক-আপ করে তারপর বেরোব। বাইক চেক-আপ করে কিছু পাওয়া গেলনা । ইঞ্জিন অয়েল প্রয়োজনের চেয়ে কিছুটা বেশি আছে। ভাবনার কিছু নেই ভেবে আমরা বেরিয়ে পড়লাম । পিঠের বোঁচকাটা আজকেও রয়েছে, তবে অনেক হাল্কা। ক্যামেরা আর জলের বোতল ছাড়া তাতে আর কিছু নেই।

এ দিনটা আমাদের কপালে একের পর এক দুর্ভোগ ছিল। কিছুদূর গিয়েই সেই ভোগান্তির প্রথম পর্ব শুরু হল। রাস্তা কালকের মতই — বেশিরভাগটাই ভাঙাচোরা, কখন কখন একটু ভাল রাস্তার মুখ দেখা যায়। ভাগা নদী চলেছে কাছে কাছেই। বেশ কয়েকবার তার দেখা পেলাম। কয়েকবার নদীর ওপর দিয়ে ব্রীজও পেরোতে হল। দুপাশে একেবারে খাড়া পাহাড়, আর তার গা বেয়ে পাথরের ঢল। রাস্তার ওপর দিয়ে ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে একটু পরে পরেই। সৌভাগ্যক্রমে জুতো না ভিজিয়ে পার করলাম প্রথম কয়েকটা। তারপরই জয়ের বাইক ফুটফাট ভুটভাট শব্দে প্রবল প্রতিবাদ জানাতে লাগল। এগোতে তার মহা আপত্তি। এই ফুটফাট শব্দটাকে ইংরিজিতে engine splutter বলে। ইঞ্জিনে পেট্রল বা হাওয়া কম গেলে এই শব্দ হয়। প্রথম সন্দেহ হল যে তেল ঠিকঠাক বইছে না। পাইপ খুলে ভালভাবে পরিষ্কার করা হল। কোথাও air bubble আছে কিনা দেখলাম — নেই। হাওয়া বন্ধ হওয়ার কথাটা, কেন জানিনা, দুজনেরই মাথায় এলনা। নয়ত air filter পরীক্ষা করতাম আর গলদটা ধরা পড়ত। তখনকার মত সমস্যাটা মিটল বলেই মনে হল, কারণ বাইক ফুটফাট ছেড়ে স্বাভাবিক ভটভট আওয়াজ শুরু করল। ফের যাত্রা শুরু।

Continue reading

জুলে! — ২

আগের পোস্টে লাদাখ ভ্রমণের গল্প শুরু করেছিলাম। এটা তারই দ্বিতীয় কিস্তি। প্রথম কিস্তিটা না পড়ে থাকলে চট করে পড়ে নিন! 🙂

।।২৯শে জুন — মানালি থেকে কেলং।।

গল্প আরো এগোনোর আগে, আমাদের যাত্রাপথ, অর্থাৎ মানালি-লেহ হাইওয়ে সম্বন্ধে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য বলে রাখা ভাল। স্বাধীনতার সময়ও ভারতের কোন জায়গা থেকে লেহ যাবার একটাই রাস্তা ছিল, শ্রীনগর-লেহ হাইওয়ে। খুব সম্ভব ১৯৬২র চীন যুদ্ধের পর (সঠিক বলতে পারবনা, তবে সে রকমই শুনেছি), লেহ যাবার এই দ্বিতীয় রাস্তা, মানালি-লেহ হাইওয়ে, তৈরি হয়। কারগিল যুদ্ধের সময় থেকে সেনাবাহিনীর কাছে এই রাস্তার গুরুত্ব অত্যন্ত বেড়ে গেছে। ভবিষ‍্যতে এই রাস্তা জাতীয় সড়ক ২১-এর অংশ হবে বলে শোনা যায়, কিন্ত এখন এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে সীমা সড়ক সংগঠন (Border Roads Organization বা BRO), NHAI নয়। মানালি থেকে লেহ-র দূরত্ব ৪৯০ কিলোমিটার। রাস্তার প্রায় পুরোটাই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অন্ততঃ ১২০০০ ফুট ওপরে। বছরের অধিকাংশ সময় বরফ পড়ে বন্ধ থাকে। যাতায়াতের উপযোগী হয় মোটামুটি জুন মাসের গোড়া থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কোন কোন বছর বরফ কম পড়লে মে মাসেও খুলে যায় রাস্তা।

স্থায়ী জনবসতি এ রাস্তায় প্রায় নেই বললেই চলে। কেলং-এই (মানালি থেকে আন্দাজ ১২০ কিলোমিটার) শেষ পাকা বাড়ি ঘর দেখা যায় । তারপর থেকে সব তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী বসতি। আবার প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পর, তাংলাংলা পাস পেরিয়ে রুমৎসে-তে স্থায়ী গ্রামের দেখা পাবেন। মানালির পর ও লেহ-র আগে প্রথম ও শেষ পেট্রল পাম্প টান্ডিতে, কেলং-এর ১০ কিলোমিটার আগে। এই কারণেই আমরা (এবং এ রাস্তায় যারা পাড়ি জমায় তারা সবাই) ক‍্যানে করে বাড়তি পেট্রল সঙ্গে নিয়েছিলাম — একবার তেল ভরে পাহাড়ী রাস্তায় ৪৫০ কিলোমিটার বাইক নাও চলতে পারে। গাড়ি বা বাসে করে গেলে এই রাস্তা দুদিন বা দেড় দিনে পার করা যায়। মোটোরবাইকে গেলে, অন্ততঃ যারা প্রথম বার যাচ্ছে, তিন দিনে যাওয়া ভাল। এর কারণ শুধু যে এক দিনে বেশি দূর যেতে না হয়, তা নয়। আসলে প্রধান কারণ, উচ্চতা এবং বাতাসে কম অক্সিজেন — এই দুইয়ের সঙ্গে শরীরকে খাপ খাওয়ানোর সুযোগ দেওয়া। কম অক্সিজেনের মধ্যে থাকার অভ্যাস না থাকলে মানুষ acute mountain sickness এর শিকার হয় — অসহ্য মাথাযন্ত্রণা, বমি ভাব, ইত্যাদি এই রোগের লক্ষণ। এবং এই রোগের কোন ওষুধ নেই — একবার হলে সমতলে (বা অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায়) নেমে আসা ছাড়া দ্বিতীয় পন্থা নেই। Diamox বলে একটা ওষুধ আছে, যেটা রক্তের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। পাহাড়ে ওঠার কয়েকদিন আগে থেকে ওষুধটা খেলে রোগের সম্ভাবনা কমে যায়। কিন্তু একবার রোগ হলে এই ওষুধ কাজে দেয় না। গাড়ি বা বাসের যাত্রীেক এ রোগে ধরলে কিছুটা ভোগান্তি ছাড়া আর কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। ড্রাইভারের হলে অবশ্য আলাদা কথা। কিন্তু কল্পনা করুন, অসহ্য মাথাব্যথা নিয়ে, বরফ ঢাকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মোটোরবাইক চালাচ্ছেন। পপাত চ, এবং সেইসঙ্গে মমার চ হওয়া প্রায় অবশ্যম্ভাবী! তাই রয়ে সয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

Continue reading

জুলে! – ১

ভূমিকাঃ এই ভ্রমণকাহিনিটি লিখেছিলাম প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে, ২০১০ সালের জুলাই-অগাস্ট মাসে। করছি করব করে আর কোথাও পোস্ট করা হয়নি। এতদিন বাক্স, থুড়ি কম্পিউটার-বন্দী হয়েই পড়েছিল। এখন নিয়মিত ব্লগিং শুরু করায় ভাবলাম এটাকে এবার ধুলো টুলো ঝেড়ে বার করা যাক। ঘটনাক্রম ২০১০ সালের জুন-জুলাই মাস, লাদাখে সেই ভয়ঙ্কর বন্যা হবার মাত্র এক মাস আগে। মোটরবাইকে লাদাখ ভ্রমণ এখন অত‍্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেটে ছড়ানো রয়েছে ভূরি ভূরি travelogue। তিন বছর আগে এতটা জলভাত হয়নি ব্যাপারটা। ইন্টারনেট ঘেঁটে পুরো প্ল‍্যানটা তৈরি করতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল সে সময়।

জুলে! – ১

(জুলে শব্দটি লাদাখি ভাষায়। লাদাখের রাস্তা ঘাটে, গ্রামে গঞ্জে এই শব্দটিই সব থেকে বেশি কানে আসে। সুপ্রভাত থেকে শুরু করে শুভরাত্রি বা ধন্যবাদ, সব অর্থেই ব্যবহৃত হয় শব্দটি। এ বছর লাদাখ ঘুরে আসার পর মনে হল যে এত বিচিত্র ঘটনাবহুল এই অভিজ্ঞতা, এটা লিপিবদ্ধ না করা অবধি শান্তি হবেনা। বুক ঠুকে বসে গেলাম কলম হাতে।)

।। প্রস্তুতি পর্ব ।।

লাদাখে ঘুরতে যাবার শখ আমার বহুদিনের। কার্যগতিকে এতদিন হয়ে ওঠেনি। অফিসে ছুটি পাওয়া যায় না, বা বাড়িতে কাজ এসে পড়ে, বা সঙ্গী যোগাড় হয় না — এই করে প্রত্যেক বছর পিছিয়ে যেতে থাকে। তার ওপর আবার বছরের সব সময় লাদাখে যাওয়া যায় না, বা গিয়েও লাভ হয় না। বছরের ছ-মাস পুরো লাদাখ চাপা পড়ে থাকে বরফের তলায়। তখন ঘোরাঘুরি অসম্ভব। মে থেকে সেপ্টেম্বর — এই ক’মাসের মধ্যেই ঘুরতে হয়। এ বছর প্রায় আদা জল খেয়ে প্রস্তুতিতে লেগেছিলাম। প্ল‍্যান হল, মোটোরবাইকে চড়ে লাদাখ ভ্রমণ। হিমাচল প্রদেশের মানালি থেকে শুরু করে লাদাখ অঞ্চলের প্রধান শহর লেহ পৌছনো, তারপর লেহ-কে কেন্দ্র করে বাকি লাদাখ ঘুরে আবার মানালি ফেরা। মানালি-লেহ হাইওয়ে বিশ্বের কঠিনতম (দাবিটি অবশ্যই বিতর্কিত) মোটোরবাইকের রাস্তা (motorbike trail) বলে খ্যাত। পাঁচটি high altitude mountain pass পেরিয়ে লেহ পৌঁছতে হয়, তার মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম গাড়ি চলার রাস্তা (এই দাবিও বিতর্কিত), তাংলাংলা-ও পড়ে। তাংলাংলার উচ্চতা ৫৩৫৯ মিটার, বা ১৭,৫৮২ ফুট। এই রাস্তায় মোটোরবাইক চালানো আমাদের দলের সকলেরই স্বপ্ন।

প্রথম প্রশ্ন — মোটোরবাইক। নিজেদের বাইক নিয়ে যাব, না ভাড়া করব মানালি বা দিল্লী থেকে ? নিজেদের বাইক ট্রেনে চাপিয়ে দিল্লী নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, বা দিল্লী থেকে ভাড়াও নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু জুন মাসের গরমে দিল্লী থেকে মানালি বাইক চালিয়ে যাবার প্রশ্নে আমাদের গায়ে জ্বর এলো। তাছাড়া, এতে যাতায়াত মিলিয়ে অন্তত চারটে দিন বাজে নষ্ট, আর সময় জিনিসটা দুর্মূল্য। সুতরাং ঠিক হল, দিল্লী থেকে বাসে করে মানালি পৌঁছে সেখান থেকে বাইক ভাড়া। এই সিদ্ধান্তটা যে কতখানি ভুল ছিল এটা তখন বুঝিনি। পরে হাড়ে হাড়ে মালুম পেয়েছিলাম।

Continue reading

ফিরে এসো চাকা

প্রথমেই বলে রাখি যে এই পোস্টের নাম যাই হোক, কবি বিনয় মজুমদারের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। 🙂

কলকাতায় গত সেপ্টেম্বর মাসে ১৭৪টি রাস্তায় সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ হয়েছে। তার মানে মোটামুটি গলিঘুঁজি ছাড়া আর কোথাও সাইকেল চালালেই জরিমানা বা হাজত বাসের সম্ভাবনা। এর বিরুদ্ধে অনেক মিটিং মিছিল, অনেক নিউজপ্রিন্ট আর কালি খরচা হয়েছে। তাই সে নিয়ে আমি আর কিছু লিখছিনা। ঘটনাচক্রে, গত ডিসেম্বর মাসে আমি আবার সাইকেল চালাতে শুরু করলাম, প্রায় চোদ্দ-পনেরো বছর পর। কিছুটা স্বাস্থ্যের কারণে, কিছুটা শুধুমাত্র সাইকেল চালাতে ভাল লাগে বলে। নতুন করে সাইকেলের প্রেমে পড়ার গল্পই আজ লিখতে বসেছি।

গোড়ায় কিঞ্চিৎ স্মৃতি রোমন্থন করা যাক। কলকাতার অনেক সুখস্মৃতির সঙ্গে সাইকেল জিনিসটা এত ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, যে সে কথা কিছুটা না বলে পারছিনা। আমি প্রথম নিজস্ব সাইকেল হাতে পাই মাধ্যমিক পরীক্ষার পর। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বেন্টিঙ্ক স্ট্রীটে গিয়ে কিনেছিলাম। একটা অ্যাটলাস রেবেল। মোটা টায়ার, সোজা হ্যান্ডেলবার, শক্তপোক্ত ফ্রেম। দাম পড়েছিল, যতদূর মনে পড়ছে, ১৩০০ টাকা। তখন দূরদর্শনে এই সাইকেলটার যে বিজ্ঞাপনটা আসত, সেটা আমার ভারি পছন্দ ছিল। এখন স্বীকার করতে অসুবিধে নেই, বিজ্ঞাপনের সুন্দরী মহিলাটি এই মডেলটা কেনার সিদ্ধান্তে আসতে অনেকটাই সাহায্য করেছিলেন 🙂 ।

Continue reading