ফিরে এসো চাকা

প্রথমেই বলে রাখি যে এই পোস্টের নাম যাই হোক, কবি বিনয় মজুমদারের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। 🙂

কলকাতায় গত সেপ্টেম্বর মাসে ১৭৪টি রাস্তায় সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ হয়েছে। তার মানে মোটামুটি গলিঘুঁজি ছাড়া আর কোথাও সাইকেল চালালেই জরিমানা বা হাজত বাসের সম্ভাবনা। এর বিরুদ্ধে অনেক মিটিং মিছিল, অনেক নিউজপ্রিন্ট আর কালি খরচা হয়েছে। তাই সে নিয়ে আমি আর কিছু লিখছিনা। ঘটনাচক্রে, গত ডিসেম্বর মাসে আমি আবার সাইকেল চালাতে শুরু করলাম, প্রায় চোদ্দ-পনেরো বছর পর। কিছুটা স্বাস্থ্যের কারণে, কিছুটা শুধুমাত্র সাইকেল চালাতে ভাল লাগে বলে। নতুন করে সাইকেলের প্রেমে পড়ার গল্পই আজ লিখতে বসেছি।

গোড়ায় কিঞ্চিৎ স্মৃতি রোমন্থন করা যাক। কলকাতার অনেক সুখস্মৃতির সঙ্গে সাইকেল জিনিসটা এত ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, যে সে কথা কিছুটা না বলে পারছিনা। আমি প্রথম নিজস্ব সাইকেল হাতে পাই মাধ্যমিক পরীক্ষার পর। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বেন্টিঙ্ক স্ট্রীটে গিয়ে কিনেছিলাম। একটা অ্যাটলাস রেবেল। মোটা টায়ার, সোজা হ্যান্ডেলবার, শক্তপোক্ত ফ্রেম। দাম পড়েছিল, যতদূর মনে পড়ছে, ১৩০০ টাকা। তখন দূরদর্শনে এই সাইকেলটার যে বিজ্ঞাপনটা আসত, সেটা আমার ভারি পছন্দ ছিল। এখন স্বীকার করতে অসুবিধে নেই, বিজ্ঞাপনের সুন্দরী মহিলাটি এই মডেলটা কেনার সিদ্ধান্তে আসতে অনেকটাই সাহায্য করেছিলেন 🙂 ।

আগে এর তার সাইকেল ধার করে চালিয়েছি। তবে সেটা ছিল দুধের বদলে পিটুলিগোলা। এবার নিজস্ব জিনিস হাতে পেয়ে একবারে ছাড়া গরু হয়ে উঠলাম। মাধ্যমিকের পর তখন অখন্ড অবসর। জনাকয় সাইকেলবিলাসী বন্ধুর দল মিলে কলকাতা চষে বেড়ানো শুরু হল। দক্ষিন কলকাতা থেকে শুরু করে ই এম বাইপাস ধরে কোনদিন নিকো পার্ক, কোনদিন বা দমদম এয়ারপোর্ট। যেতে আসতে প্রায় ৫০ কিলোমিটার বা তারও বেশি। তখনো বাইপাসের অধিকাংশটাই চার লেন হয়নি। দুপাশে এখন যে বহুতল আবাসনগুলো ভিড় করে রয়েছে, তার একটাও তখন ছিল বলে মনে পড়ছেনা। প্রায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে সাঁইসাঁই করে চলত আমাদের সাইকেল গ্যাং। সাইকেল রেস, বড় রাস্তায় অটো রিকশা বা বাসের সঙ্গে পাল্লা টানা, এসব তো নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল। সে বয়সে পায়ের জোরের অভাব হয়নি, আর গরম, ঘাম, ধুলো — এসব ধর্তব্যের মধ্যেই আনতাম না। উৎসাহের চোটে একদিন সাইকেল নিয়ে উঠে গেছিলাম বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর। জানতাম না যে ওখানে সাইকেল নিয়ে যাওয়া বারণ। ফেরার সময় দেখা দুই মূর্তিমান ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে — আমাদের দেখে মিটিমিটি হাসছে আর গোঁফে চাড়া দিচ্ছে। আর যায় কোথায়! অনেক কেঁদে ককিয়ে এবং করকরে পঞ্চাশটি টাকা মামার পকেটে গুঁজে সেদিন সাইকেল সমেত ছাড়া পেয়েছিলাম। পঞ্চাশ টাকা তখন আমাদের কাছে অনেক টাকা। সেই শোকে প্রায় এক মাস ফুচকা, আলুর চপ, এগ রোল — কিচ্ছুটি মুখে তুলিনি (মানে ট্যাঁকে কুলোয়নি আর কি!)।

উঠতি বয়স আর ঝাঁ চকচকে নতুন সাইকেল। সেসময়কার আর পাঁচটা সাইকেলের তুলনায় দেখতেও বেশ ভাল। সেই সাইকেল দেখিয়ে পাড়ার বা স্কুলের মেয়েদের ‘ইমপ্রেস’ করার যে একটা নাতিপ্রচ্ছন্ন ইচ্ছা ছিল, সেটা অস্বীকার করবনা। এক বন্ধু (যার নিজস্ব সাইকেল ছিলনা এবং প্রায়শই আমার সাইকেলটা ধার চাইত) সেই উৎসাহে ঠান্ডা জল ঢাললো কিছুটা। ব্যাটা বলে কিনা — ওরে, সাইকেল দেখে মেয়েরা পটেনা। মেয়ে পটাতে চাস তো মোটরবাইক চালা। বোঝো কান্ড! মধ্যবিত্তের ছেলে বহু কষ্টে সৃষ্টে সাধ্য সাধনা করে একটা সাইকেল জোগাড় করেছি। এখন বাড়িতে গিয়ে মোটরবাইক চাইলে দু গালে দুটো থাপ্পড় ছাড়া আর কিছু মেলার আশা করা বাতুলতা। আমার সাইকেলই ভাল। তাতে যদি মেয়েরা ইমপ্রেস না হয় তো না হবে। কি আর করা! 😦

নতুন সাইকেলের তখন কি যত্ন! প্রত্যেক রবিবার সকালে তেল দিয়ে ঘষে ঘষে ফ্রেম, হ্যান্ডেল, এক একটা স্পোক, সব পরিষ্কার হত। চেন থেকে খুঁটে খঁুটে কাদা বার করতাম। চাকার ‘হাব’এ দিতাম সেলাই মেশিনের তেল। সব সময় নজর, যেন জল লেগে মরচে না পড়ে।

উচ্চ মাধ্যমিকের দুটো বছর কলেজ এবং টিউশন সাইকেলের ওপর দিয়েই চলেছিল। এরপর এল কলেজ। কলকাতার পাত্তাড়ি গুটিয়ে খড়গপুর। বিরাট বড় ক্যাম্পাস। যাতায়াতের জন্য সাইকেল ছাড়া গত্যন্তর নেই। ছাত্ররা তো বটেই, মাষ্টারমশাইরাও (অন্ততঃ সেই সময়) দুচাকাতেই ভরসা করতেন। কলকাতা থেকে সাইকেলটা খড়গপুর নিয়ে যাবার প্রয়োজন পড়ল। একটা সহজ উপায় ছিল — হাওড়া স্টেশন অবধি চালিয়ে নিয়ে গিয়ে তারপর লোকাল ট্রেনের vendor কামরায় উঠে চলে যাওয়া। সাধারণ কামরায় সাইকেল নিয়ে উঠতে না দিলেও vendor কামরায় কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্ত তিন ঘন্টার রাস্তা মাছের আর ছানার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে যেতে মন উঠলনা। প্ল্যান হল সাইকেলের চাকা টাকা সব খুলে বস্তাবন্দী করে নিয়ে যাব খড়গপুর। তারপর ওখানে গিয়ে আবার জোড়া লাগাব। যেমন কথা তেমন কাজ। বসে গেলাম হাতুড়ি, স্প্যানার, স্ক্রু ড্রাইভার আর প্লায়ার্স নিয়ে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সাইকেলটা পরিণত হল চাকা, ফ্রেম, চেন, হ্যান্ডেল আর অসংখ্য নাট বল্টুর স্তূপে। সেই স্তূপকে বস্তায় চালান দিয়ে ট্রেনে করে সোজা খড়গপুর। হস্টেলের সাইকেল শেডে বসে আবার সেটাকে জোড়া লাগানো। ভাগ্য ভাল, সবকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই বস্তায় ভরেছিলাম এবং আবার ঠিকঠাক জোড়া লাগাতে পেরেছিলাম।

কলেজের চারটে বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। জীবনে সাইকেলের গুরুত্ব এবং সাইকেলের প্রতি যত্ন, দুটোই চার বছরে কিছুটা কমেছিল। তাও ভালবাসাটা বেঁচে ছিল। সেই চার বছরে সাইকেল নিয়ে কম চরকিপাক খাইনি। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে খড়গপুর শহরের এঁদো হলে সিনেমা দেখতে যাওয়া, বা হাইওয়ের ধাবাতে খেতে যাওয়া। হিজলির গ্রামের স্কুলে পড়াতে যাওয়া (এন এস এস করতে হয়েছিল এক বছর)। কখনো কখনো মেদিনীপুর অবধি পাড়ি দেওয়া। সব ঐ দুচাকার দৌলতে। ইচ্ছে ছিল চার বছর শেষ হলে সাইকেলটা আবার কলকাতা নিয়ে আসা। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেটা আর সম্ভব হয়নি। একটি জুনিয়র ছেলের সাইকেল আমার হেফাজতে থাকা অবস্থায় চুরি হয়েছিল। ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তাকে বলেছিলাম ক্যাম্পাস ছাড়ার আগে আমার নিজের সাইকেলটা তাকে দিয়ে যাব। সেই কথা অনুযায়ী কলেজের শেষ দিন চাবিটা তার ঘরে রেখে কলকাতা পাড়ি দিয়েছিলাম। প্রথম জীবনের সাইকেল পর্বের সেই ইতি।

অনেক স্মৃতি রোমন্থন হল। এবার প্রায় দেড় দশক ‘ফাস্ট ফরোয়ার্ড’ করে বর্তমান সময়ে চলে আসা যাক। চাকরিজীবনে সেভাবে কখনো খেলাধুলো বা ব্যয়াম করিনি নিয়মিত। এদিকে কিছুদিন হল শ্রীমতী ভেতো বাঙালি এক ভয়ঙ্কর ‘ফিটনেস রেজিম’ শুরু করেছেন, একটা বিরাট ইভেন্টে অংশ নেওয়ার জন‍্য। তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হলাম। মনে হল বয়স হচ্ছে — এবার নিজের ‘ফিটনেস-লেভেল’টাও বাড়ানো যাক।। নয়ত একদিন হঠাৎ করে শরীর বসে যাবে। হাতের কাছে ‘জিম’ নেই, এবং ‘জিম’এ যাবার সময়ও নেই। যা করার নিজেই করতে হবে। দৌড়লাম কয়েকদিন। দেখি যে দম অকুলান না হলেও পিচের রাস্তায় দৌড়ে পায়ের পাতায় ব্যথা হচ্ছে। সাঁতার কাটতে খুবই ভাল বাসি, কিন্তু নিয়মিত সাঁতার কাটার জায়গা নেই। কি করি? হঠাৎ করে মাথায় এল — সাইকেল চালালে কেমন হয়? একটা সাইকেল কিনতে হয় তাহলে। মুশকিল হচ্ছে যে সাইকেল বস্তুটি গত কয়েক বছরে অনেকটাই বদলে গেছে আর এই নতুন প্রজন্মের সাইকেল সম্বন্ধে আমার প্রত্যক্ষ জ্ঞান প্রায় শূন্য। সে সময় গিয়ার-ওয়ালা সাইকেল ছিল মোটে একটা কি দুটো মডেল, এবং সেই গিয়ার থেকে থেকেই বেগড়বাঁই করত। এখন অধিকাংশ সাইকেলেই গিয়ার থাকে। আগে হিরো-হারকিউলিস-অ্যাটলাস-ইত্যাদি হাতে গোনা কয়েকটা ব্র্যান্ড ছিল। এখন সে ব্র্যান্ড গুলো তো আছেই, আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বেশ কিছু ‘প্রিমিয়াম’ বিদেশী ব্র্যান্ড। দামও আকাশ ছোঁয়া। অফিসের ক্যান্টিনে বসে একদিন এই নিয়েই গল্প করছিলাম। এক সহকর্মী বললেন — আমার কাছে একটা নতুন সাইকেল প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সেটা নিয়ে কয়েক দিন চালিয়ে দেখুন। যদি ভালো লাগে তো নিজে একটা কিনে নেবেন। প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। একদিন সন্ধ্যাবেলা সেই সহকর্মীর বাড়ি গিয়ে সাইকেলটা নিয়ে এলাম। মোটা চাকার সাইকেল — একুশটা গিয়ার (সামনে তিনটে, পেছনে সাতটা, তিন সাত্তে একুশ)। ফ্রেমটাও কিছুটা কিম্ভূত আকৃতির, পুরোনো সাইকেলের সঙ্গে মেলেনা একেবারেই। গিয়ার ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে ভাগ্যক্রমে বেশি দেরি হলো না। তার পরদিনই বেরিয়ে পড়লাম কিছু দূরে একটি বন্ধুর বাড়িতে। যেতে আসতে প্রায় ৩০ কিলোমিটার।

দুদিন সাইকেল চালিয়ে কয়েকটি মৌলিক সত‍্য অনুধাবন করলামঃ

১) এখনকার ব‍্যঙ্গালোরে সাইকেল চালানো আর কুড়ি বছর আগের কলকাতায় সাইকেল চালানোর মধ‍্যে বিস্তর ফারাক। কলকাতার রাস্তা প্রায় সমতল — ওভারব্রিজে না উঠলে চড়াই ভাঙতে হয়না। ব‍্যাঙ্গালোরের রাস্তা ঢেউ খেলানো। ক্রমাগত উঁচুনিচু, সমানে চড়াই উৎরাই করতে হয়। আর হাঁটুর জোর এই কুড়ি বছরে কমেছে বই বাড়েনি। ফল অবধারিত — প্রথম দুদিন বেশ হাঁপ ধরল।
২) মোটরবাইক আর গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে গতি সম্বন্ধে ধারণাটা পাল্টে গেছে। আগে যে স্পিডে সাইকেল চালালে মনে হত যথেষ্ট, এখন সেই স্পিডটাই অত‍্যন্ত কম মনে হচ্ছে। ক্রমাগত জোরে চালাবার চেষ্টা করছি। এর ফলও এক — হাঁপ ধরা।
৩) ৩০ কিলোমিটার চালিয়ে শরীরের একটিমাত্র জায়গায় ব্যথা হল। পায়ে নয়, হাঁটুতে নয়। ব‍্যথা হল পশ্চাদ্দেশে। এমন মোক্ষম ব‍্যথা যে তার জ্বালায় পুরো একটা দিন চেয়ারে অবধি বসতে অসুবিধে হচ্ছিল। 🙂

প্রথম দুটো সমস্যা না হয় কিছুদিন চালানো অভ্যেস করলে আপনিই মিটে যাবে। কিন্তু তৃতীয় সমস‍্যাটার কি করি? এ ব‍্যথা চলতে থাকলে তো সাইকেল চালাতেই পারবনা। পুরোনো সাইকেলটার সিটের নিচে স্প্রিং ছিল। ক‍্যাঁচকোঁচ শব্দ করত বটে, কিন্তু ছিল বিলক্ষণ আরামদায়ক। এখনকার সাইকেলগুলোর সিট হয় সরু, আর কাঠের মত শক্ত। ব‍্যথার উৎপত্তি সেখান থেকেই। কিন্তু লোকে তো সেই সিট নিয়েই দিব‍্যি চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কি আমার পশ্চাদ্দেশটিই অতিরিক্ত স্পর্শকাতর? ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়? উঁহু! তাতো মনে হয় না। তবে সমস‍্যাটা কোথায়? নাঃ, ব‍্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখতে হচ্ছে।

লেগে পড়লাম ‘রিসার্চ’এ। ইন্টারনেটে খুঁজেপেতে, বহু ব্লগ বা ‘ডিসকাশন ফোরাম’ পড়ে আধুনিক সাইকেল সম্বন্ধে বিস্তর জ্ঞানলাভ হল। পশ্চাৎপীড়ার সমাধানও খুঁজে পেলাম। সেই সদ‍্যলব্ধ জ্ঞান আরেকদিন বিতরণ করব। এই ব্লগ পোস্টটা শুরু করেছিলাম হাল্কা মেজাজে। টেকনিকাল কচকচি আর এখানে আনছিনা।

ফিরে আসা যাক সমস‍্যার সমাধানে। পড়েশুনে যা বুঝলাম, তাতে মনে হল যে গলদটা একেবারে গোড়ায়। যেভাবে এতদিন সাইকেল চালিয়েছি, সেটা ভুল। আগে সবসময় চেষ্টা করতাম যে সিটে বসে যেন মাটিতে পা পৌঁছয়। ভিড় রাস্তায় চালাতে হলে সেটাই সুবিধে, কারণ বারবার থামতে থামতে যেতে হয়। থামাবার জন‍্য সিট থেকে নেমে পড়তে হলে অসুবিধে। কিন্তু আসল নিয়ম হল সিটটা কিছুটা উঁচু রাখা। সিটের উচ্চতা ঠিক করার একটা সহজ ফর্মুলা আছে। সাইকেলে উঠে কাউকে বলুন পেছন থেকে ধরে থাকতে। এবার দুপায়ের গোড়ালি প‍্যাডেলের ওপর রেখে দাঁড়িয়ে পড়ুন। একটা প‍্যাডেল নামিয়ে আনুন একদম নিচে। সিটের উচ্চতা ততটাই হওয়া উচিত, যাতে এই অবস্থায় আপনি সিটে বসে থাকতে পারবেন (এখনকার বেশিরভাগ সাইকেলে সিট ওঠানামা করার জন্য স্ক্রুড্রাইভারের প্রয়োজন পড়েনা — একটা ক্ল‍্যাম্প খুলেই দিব‍্যি সিট ওপর নিচে করা যায়)। এর ফলে মাটিতে পা পৌঁছবেনা। সাইকেল স্টার্ট করার সময় বা থামাবার সময় সিট থেকে সামনে নেমে পড়তে হবে। কিন্ত সিট উঁচু থাকলে অনেকগুলো সুবিধে পাওয়া যায়। প্রথমতঃ শরীরের পুরো ভরটা সিটের ওপর পড়েনা। ভাগ হয়ে যায় সিট, পা আর হাতের মধ্যে। দুই পা’কে শক অ‍্যাবজর্বার হিসেবেও ব‍্যবহার করতে পারবেন অনেক সহজে — খানাখন্দের মধ‍্যে দিয়ে চালাতে সুবিধে। পশ্চাৎপীড়ার সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয়তঃ সিট উঁচু থাকলে প‍্যাডেল করার সময় হাঁটু ভাঁজ হয় কম — পা দুটো অপেক্ষাকৃত সোজা থাকে। এর ফলে হাঁটুতে কম চাপ পড়ে। ‘প‍্যাডেলিং এফিসিয়েন্সি’ বেড়ে যায়। অনেক বেশিদূর যাওয়া যায়। চড়াই ভাঙতেও সুবিধে। এই ফর্মুলা প্রয়োগ করে দুদিন চালিয়ে দেখলাম। ব‍্যথা মন্ত্রের মত উধাও! হাঁপও ধরছে কম। শুধু একটাই অসুবিধে। একেবারে ভিড় জ‍্যাম রাস্তায় চালানোটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। সে সময় নেমে পড়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাই ভিড় একটু পাৎলা না হওয়া অবধি।

কয়েকদিনের মধ‍্যেই বুঝলাম যে পুরোন প্রেম আবার মাথা চাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে। নিজেকে গালাগালি দিতে লাগলাম এত বছর প্রেমিকার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার জন‍্য। সাইক্লিং অ‍্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়ার জন‍্য হাত নিশপিশ করতে থাকল। ভেবেচিন্তে (এবং আরেক প্রস্থ রিসার্চ করে) জানুয়ারি মাসের গোড়ায় একটা সাইকেল কিনেই ফেললাম। ভেবেছিলাম একটা ‘রোডস্টার’, মানে সেই পুরোন আমলের সবুজ রঙের বড় চাকার সাইকেল, কিনব। কিছুদিন ওটাতেই চালিয়ে নিয়ে পরে নাহয় বড় মাছের দিকে হাত বাড়ানো যাবে। কিন্তু দেখা গেল যে শ্রীমতী ভেতো বাঙালির তাতে ভয়ঙ্কর আপত্তি। ওই সাইকেল চালালে প্রেস্টিজ পাংচার। অতএব কিনতে হল একটা দামি সাইকেল। মডেলটার নাম Bergamont Helix 2.3। জার্মান কম্পানি। এটাকে বলা হয় ‘হাইব্রিড বাইক’ — চেহারাটা মোটা টায়ারের ‘মাউন্টেন বাইক’ অার পাৎলা সরু টায়ারের ‘রেসিং বাইক’এর মাঝামাঝি। শহরের রাস্তায় এবং কিছুটা মেঠো রাস্তায় চালানোর উপযোগী। চাকাগুলো বড় বড়, ২৯ ইঞ্চির। ফ্রেম এবং চাকাগুলো তৈরি একটা অ‍্যালুমিনিয়াম অ্যালয় দিয়ে, অত‍্যন্ত হাল্কা। ২১ গিয়ারের দৌলতে সে প্রায় উড়ে চলে বললেই হয়। চড়াই না থাকলে ঘন্টায় ৩০ কিলোমিটার স্পিডে যাওয়াটাও মনে হয় জলভাত।

এরপর? আর কি! ‍ব‍্যাঙ্গালোর চষে বেড়াচ্ছি। সপ্তাহে বেশ কয়েকদিন সাইকেল করে অফিস যাত্রা। যেতে আসতে প্রায় ২১-২২ কিলোমিটার। এছাড়া এদিক ওদিক অল্পসল্প ঘোরাঘুরি তো আছেই। এখনো খুব দূরের পাল্লা টানিনি। তবে খুব শিগগিরি টানবার ইচ্ছে আছে। অ‍্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়ার জন‍্য হাত নিশপিশ করছে। সাইকেলের যত্নটাও শুরু করেছি আবার সেই ছোটবেলার মত। এটা স্টিলের তৈরি নয় — মরচে পড়বে না। তাই তেল দিয়ে পরিষ্কার করার দরকার পড়েনা। তবে বাকি কাজ গুলো আগের মতই করছি।

পোস্টের শেষটা ঠিক জুতের হলনা বুঝতে পারছি। কিন্ত আর কিছু বলার নেই এই মুহূর্তে। 🙂 তাই আজকের মত এই পর্যন্তই। কিছুদিনের মধ্যেই অ‍্যাডভেঞ্চারের গল্প নিয়ে হাজির হব। তিন সত‍্যি!

One thought on “ফিরে এসো চাকা

Leave a comment