চরৈবেতি! — ৩

।। দ্বিতীয় দিন ।।

সাত নম্বর চেক পয়েন্টে পৌছে সবাই কিছুক্ষণের জন্য বডি ফেলে দিল। কুন্ডলী পাকিয়ে একই মাদুরে চারজন লম্বা হল। তখন বেশ শীত, সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে হু হু করে। কিন্তু সবাই পায়ের ব্যথা আর ক্লান্তিতে জেরবার। ঠান্ডার দিকে ভ্রূক্ষেপ করার অবস্থা নেই কারো। শুশ্রুষা চলল শ্রীমতীর জখম পায়ের। কিছুটা স্ট্রেচিং করার পর মনে হল অবস্থাটা অপেক্ষাকৃত ভাল হল। অন্তত উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা চলা করতে পারছিলেন। এখানে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে ভোর চারটে নাগাদ বেরোবার প্ল্যান হল। আমার ইচ্ছে ছিল বাকি রাতটাও ওদের সঙ্গে চলা। কিন্তু উপায় নেই। সেই ছেলে দুটি — মানে যারা ব্যাঙ্গালোর থেকে বিরিয়ানি নিয়ে এসেছিল আর ছ’নম্বর চেক পয়েন্ট থেকে আমার গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে এসেছে — তাদের এবার ফিরতেই হবে। অগত্যা আমাকেই গাড়ি চালাতে হবে।

মাদুরের ওপর কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুম।

মাদুরের ওপর কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুম।

চারটে বা সাড়ে চারটে নাগাদ টিম বেরিয়ে পড়ল আবার। পেন কিলারের জোর নাকি স্ট্রেচিং-এর ফল সেটা জানিনা, তবে দেখলাম শ্রীমতী আবার মোটামুটি হাঁটতে পারছেন। ওরা বেরিয়ে গেলে আমি আর পুষ্পরাজ একটু ঘুমোবার মতলব করলাম। গত আটচল্লিশ ঘন্টার মধ‍্যে ঘন্টা চারেকের বেশি দু’চোখের পাতা এক করিনি। তারপর সারাদিন দু’পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্লান্তি তো আছেই। চোখে ঘুমের পাহাড় ভেঙে পড়ছিল। পৌনে ছ’টার অ্যালার্ম লাগিয়ে আমি চেক পয়েন্টের ভেতরে ঢুকে তোষকের ওপর গা এলিয়ে দিলাম।

ভাগ্য ভাল যে অ্যালার্মের শব্দে ঘুমটা ভাঙল (কারণ আমার অ্যালার্ম বাজাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নাক ডাকিয়ে ঘুমোনোর খ্যাতি সর্বজনবিদিত)। ঠেলে তুললাম পুষ্পরাজকে। এখনি গাড়িটা নিয়ে বেরোতে হবে। উঠে দেখি ঠান্ডায় সর্দি লেগে গেছে বেজায়। নাক দিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। নাক টানতে টানতে আর হাঁচতে হাঁচতে গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম। তখন ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। আট নম্বর চেক পয়েন্টে যাওয়ার গাড়ি চলা রাস্তাটা বেশ লম্বা। রাস্তা চিনে পৌঁছতে আধ ঘন্টা লেগে গেল। এই চেক পয়েন্টটা স্কুলে নয়। একটা ছোট্ট টিলার মত পাহাড়, তার ওপর মন্দির। সেই মন্দিরের আশপাশের জায়গার ওপর সামিয়ানা টাঙিয়ে চেক পয়েন্ট। গাড়ি নিয়ে সেই টিলার ওপর ওঠা যায়, তবে রাস্তা বেশ খাড়া। সাবধানে উঠতে হয়।

টিম এসে পৌঁছবার আগেই ব্রেকফাস্টের প্যাকেটগুলো জোগাড় করতে হবে। সঙ্গে যা খাবার আছে তাতে ছ’জনের হবে না। কিন্তু খাবার চাইতে গিয়ে যা শুনলাম তাতে মাথায় বাজ পড়ল। খাবার এখানে পাওয়া যা‍বেনা। পাওয়া যাবে সাত নম্বর চেক পয়েন্টে, যেটা আমরা পেরিয়ে এসেছি। ভোর বেলা বেরিয়েছি ওখান থেকে, তখনো খাবার এসে পৌঁছয়নি। তাই ব্যাপারটা বুঝিনি আমরা। এখন উপায়? দোকান পাট খুলতে দেরি আছে, তাই খাবার কেনার চেষ্টা করে লাভ নেই। তাছাড়া এই পাড়াগাঁয়ের দোকানে কি খাবার পাওয়া যাবে তারও কোন ঠিক আছে? তাহলে কি ফিরে যাব আগের চেক পয়েন্টে? কিন্তু আমরা সেখান থেকে ফিরে আসার আগেই যদি টিম এখানে এসে হাজির হয়? রাস্তা তো কম নয়। চেক পয়েন্টে হা-ক্লান্ত হয়ে পৌঁছে আমাদের টিকির দেখা না পেলে কি হবে সেটা ভেবেই শিউরে উঠলাম। কিন্তু বিনা খাবারে শুধু আমাদের চাঁদবদন দেখেই যে তারা হর্ষোৎফুল্ল হয়ে উঠবে এটা মনে করারও কারণ নেই! কিছু একটা উপায় দেখতে হবে।

গাড়ি তোলপাড় করে খুঁজে কিছু পাঁউরুটি, মাখন আর ফল বেরোল। এ ছাড়া ফলের রস, এনার্জি ড্রিঙ্ক ইত্যাদি ছিল যথেষ্ট পরিমাণে। চেক পয়েন্ট থেকে কয়েকটা ম্যাগি ইনস্ট্যান্ট নুডল্ যোগাড় করা হল (মানে যেগুলোতে শুধু গরম জল দিয়ে দু’মিনিট রেখে দিলেই সেদ্ধ হয়ে যায়)। দেখে শুনে মনে হল যে ছ’জন না হোক অন্তত চারজনের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। গোলমালটা যখন পাকিয়েছি আমি আর পুষ্পরাজ, তখন আমরা দু’জন নাহয় শাস্তিস্বরূপ পেটে কিল মেরে থাকব কিছুক্ষণ।

টিমের জন্য অপেক্ষা করে আছি, কিন্তু তারা আর এসে পৌঁছয় না। হিসেব মত সাতটা, বড়জোর সোওয়া সাতটার মধ্যে হাজির হওয়ার কথা তাদের। কিন্তু তারা এসে পৌঁছল পোনে আটটা নাগাদ। কারণটা বুঝলাম তারা এসে পৌঁছবার পর। সাত থেকে আট নম্বর চেক পয়েন্টের রাস্তাটা সব থেকে পাহাড়ি। আর পুরোটাই প্রায় চড়াই। রাস্তা নেই বললেই চলে। পায়ে চলা পাকদন্ডীর মত পথ। কোথাও কোথাও তাও নেই। স্রেফ ধারালো নুড়ি বেছানো খাড়া পাহাড়ের গা। ওগুলো আসলে পথও নয়, নদীখাত। বর্ষাকালে ওখান দিয়ে পাহাড়ি নদী বা ঝর্ণা বয়ে যায়। সেই দুর্গম পথ ঘুরঘুট্টে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে এসেছে ওরা, শারীরিক শক্তির শেষ প্রান্তে এসে! চোদ্দপুরুষের ভাগ্য যে কেউ আছাড় খেয়ে ঠ্যাং মচকায়নি। বর্ণনা শুনে আমাদের মুখ হাঁ, চোখের পলক পড়েনা। সম্বিৎ ফিরতে পড়ি মরি করে খাবারের আয়োজন করতে লাগলাম। পুষ্পরাজ লেগে গেল মালিশের কাজে। ওরা এত ক্লান্ত যে ঠিক করে কিছু খেতেও পারলনা। কোনরকমে কিছু নাকে মুখে গুঁজে দুজন চলে গেল সামিয়ানার ভেতর তোষকের ওপর গা এলিয়ে দিতে। শ্রীমতী আর প্রাক্তন সৈনিক বাইরে রোদের মধ‍্যে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন।

আট নম্বর থেকে ন’নম্বর চেক পয়েন্টের উদ্দেশ‍্যে রওনা হওয়া গেল সাড়ে ন’টা নাগাদ। এই রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত সহজ। পুরোটাই পিচের রাস্তা আর চড়াই উৎরাই নেই খুব একটা। কিন্তু সে রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে দেখি যে আরেক বিপত্তি। কর্ণাটকের মুখ‍্যমন্ত্রী নাকি সেখানে আসছেন আজ কোন কাজে। রাস্তা বন্ধ। ইভেন্টের প্রতিযোগীদের যেতে দিচ্ছে, তবে গাড়ির যাওয়া নিষেধ। অগত্যা ঘুর পথে যেতে হল। টিমের সঙ্গে আর দেখা হলনা রাস্তায়।

ন’নম্বর চেক পয়েন্টটা একটা গ্রামের মধ্যে। একবারে হতদরিদ্র গ্রাম, একটা দোকান অবধি নেই। ততক্ষণে সূর্য প্রায় মাঝ গগনে। চারিদিক একেবারে শুকনো খটখটে, হাওয়ায় লাল ধুলোর মেঘ উড়িয়ে আনছে। গাছপালা এমনিতেই কম, তার ওপর আবার এত শুকনো অবস্থা যে এক ফোঁটা ছায়া নেই কোথাও। চেক পয়েন্টটা বেশ ছোট, বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা বেশি নেই। আমি একটা চৌকির ওপর বসে একটু জিরোচ্ছিলাম। বাইরে ঝিম ঝিম করা দুপুর আর হাওয়ায় গাছপাতা দুলে ওঠা দেখতে দেখতে কখন যে চোখটা বুজে এসেছে জানিনা। যখন ঘুম ভাঙল ততক্ষণে আমাদের টিম চেক পয়েন্ট ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে। বেটা পুষ্পরাজ আমাকে ডাকেনি এতক্ষণ। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম। ফিনিশিং লাইন এখান থেকে মোটামুটি বারো কিলোমিটার।

দিল্লী আর দূর নয়! মাত্র বারো কিলোমিটার!

দিল্লী আর দূর নয়! মাত্র বারো কিলোমিটার!

এবারো পায়ে চলার আর গাড়ির পথ আলাদা। কিন্তু আমরা ঠিক করলাম যে যা হয় হোক, পায়ে চলার রাস্তা দিয়েই গাড়ি নিয়ে যাব। এখন টিমের সঙ্গে থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। এরপর পাহাড়ি পাকদন্ডী আর নেই, বড়জোর মেঠো পথ। সেখান দিয়ে আমার ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ির যেতে খুব অসুবিধে হবার কথা নয়। দেখলাম ব্যাপারটা তাই। রাস্তা লাল মাটির হলেও খুব একটা এবড়ো খেবড়ো নয়। তবে অসম্ভব ধুলো, আর ছায়ার নাম গন্ধ নেই কোথাও। আমার গাড়ির রঙ যে আদতে বাদামি, সেটা আর দেখে বোঝার জো নেই। একবারে লালবর্ণ ধারণ করেছে। কিছুদূর গিয়ে একটা গ্রামের মধ্যে আমাদের টিমের দেখা পেলাম। ক্লান্তিতে মূহ্যমান, প্রায় মরা মানুষ হেঁটে যাবার মত চেহারা সব। মাথায় ভিজে গামছা জড়িয়ে রোদের হাত থেকে বাঁচার একটা ক্ষীণ প্রচেষ্টা চলছে, তবে তাতে যে খুব একটা কাজ হচ্ছে দেখে তো মনে হলনা। জল ঢাললে মুহুর্তের মধ্যে উবে যাচ্ছে।

লাল মাটির রাস্তা বেয়ে চলেছে আমাদের টিম।

লাল মাটির রাস্তা বেয়ে চলেছে আমাদের টিম।

কাল বিকেলে যে ফর্মুলা লাগিয়েছিলাম, সেটাই আবার প্রয়োগ করলাম। মানে কিছুদূর গিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে টিমের অপেক্ষা করা। তাদের পার করে আবার কিছুদূর গিয়ে অপেক্ষা। রাস্তা আবার চড়াই। কোন কোন জায়গায় রাস্তা খুব সরু, আর দুপাশে দুর্ভেদ্য ঝোপঝাড় — গাড়ি দাঁড় করাবার জায়গা নেই। রাস্তা চলেছে পাহাড়ের ওপর দিয়ে। একটা পাহাড় পেরিয়ে কিছু গাছ গাছালির দেখা পেলাম। কয়েকটা গ্রাম রয়েছে এদিক ওদিক। একটা গ্রামের মধ্যে গাড়ি দাঁড় করলাম। পুষ্পরাজ একজন গ্রামের লোকের সঙ্গে বেশ গল্প জুড়ে দিল। আমি কান্নাড়া ভাষা বলতে না পারলেও মোটামুটি বুঝতে পারি। তাই গল্প জমাতে অসুবিধে হলনা।

হম হ্যায় রাহী প্যার কে, হম সে কুছ না বোলিয়ে। যো ভি প্যার সে মিলা হম উসি কে হো লিয়ে!

হম হ্যায় রাহী প্যার কে, হম সে কুছ না বোলিয়ে। যো ভি প্যার সে মিলা হম উসি কে হো লিয়ে!

রাস্তা সরু থাকায় বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি দাঁড় করাতে পারিনি, তাই টিমের সঙ্গে দেখা হয়নি অনেকক্ষণ। টিম যখন সেই গ্রামে এসে পৌছল তখন তাদের অবস্থা দেখে বোধহয় পাথরের মূর্তির চোখেও জল এসে যাবে :-)। বসতে পেলে এলিয়ে পড়বে আর একবার এলিয়ে পড়লে যে আবার উঠতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কোনরকমে গ্লুকোজ টুকোজ খাইয়ে কিছুটা চাঙ্গা করলাম তাদের। তারপর আবার যাত্রা শুরু। টিমের একটি ছেলে, তার নাম ‍বিবেক, সে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে মেয়ের সঙ্গে দোলনায় বসে কিছুটা আরাম করে নিল! 🙂

এর পর থেকে আর এক কিলোমিটার নয়, প্রায় পাঁচশো মিটার পরে পরেই গাড়ি দাঁড় করাতে থাকলাম। পুষ্পরাজ এবার গাড়ি ছেড়ে টিমের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলো। শেষ মুহুর্তে ক্রমাগত উৎসাহ যোগানো জরুরি। এক এক পা-ই তখন এক এক মাইলের সামিল। টিমের একজন তিন কিলোমিটারের মধ্যে তিনবার জুতো বদল করল। পায়ের তলায় ক্রমাগত ঘষা লাগতে লাগতে অসহ্য জ্বালা শুরু হয়েছে। জুতো বদল করলে সাময়িক আরাম পাওয়া যায়। শ্রীমতীর ডান হাঁটুতে আর কোন সাড় নেই, হাঁটু ভাঁজও হচ্ছেনা। শক্ত একটা লাঠির মত হয়ে গেছে পা। ডান্ডা দিয়ে মারলেও আর কিছু টের পাবেননা, এমন অবস্থা! দেখেশুনে পুষ্পরাজ বলল যে ব্যথা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে আর মালিশ বা স্ট্রেচিং-এ লাভ হবেনা। একমাত্র ওষুধ বিশ্রাম।

অনুক্ত প্রশ্নটা হল  — পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো বল কবে শেতল হব। কত দূর, আর কত দূর? বল মা!

অনুক্ত প্রশ্নটা হল — পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো বল কবে শেতল হব। কত দূর, আর কত দূর? বল মা!

গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা হচ্ছে বহু লোকের সঙ্গে। সবারই প্রায় একই অবস্থা। চলতে চলতেই শুয়ে পড়ে আর কি! অনেকেই জল চাইল, কেউ গ্লুকোজ চাইল। এক জায়গায় দেখা হল কালকের সেই সাপোর্ট ক্রু’র দলের সঙ্গে — যারা রাস্তার ধারে বসে তাস খেলছিল। সেই দলের একজন আমাকে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার টিম কোথায়?’
– ‘পেছনেই আছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এখানে এসে যাবে।’
– ‘ও। আপনি বুঝি রাস্তায় অপেক্ষা করতে করতে আসছেন?’
– ‘হ্যাঁ। আপনাদের টিম কোথায়?’
– ‘আমি না মানে ঠিক জানিনা। অনেকক্ষণ দেখা হয়নি। কোথায় আছে ঠিক বলতে পারছিনা।’
– ‘আপনারা টিমের জন্য রাস্তায় দাঁড়াননি?’
– ‘না ‍— মানে চেক পয়েন্ট থেকে বেরিয়ে এই প্রথম দাঁড়ালাম।’
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!

ফিনিশিং লাইন ক্রমে কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। আর মাত্র দু’ কিলোমিটার, … আর মাত্র দেড়, … মাত্র এক! আরেকটু গেলেই পৌঁছে যাব। এখন হাল ছেড়োনা, এগিয়ে চল! যখন এক কিলোমিটার মত বাকি, আমি গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ফিনিশিং পয়েন্টে গাড়ি রেখে আবার ফিরে আসব। ফিনিশিং পয়েন্টটা হল ঈগলটন রিসর্ট বলে ব্যাঙ্গালোরের কাছেই একটা রিসর্টে। সেখানে অভ্যর্থনার এলাহি ব্যবস্থা। স্টেজ রয়েছে প্রেজেন্টেশনের জন্য। প্রচন্ড জোরে গান বাজছে। আর এক স্থানীয় লোকনৃত্যের দল হাজির, নাচিয়ে বাজিয়ে নিয়ে। কেউ ফিনিশিং পয়েন্টে পৌঁছলেই ঢাক ঢোল বাজিয়ে নেচে কুঁদে তাদের অভ্যর্থনা করছে। গাড়িটা রেখেই দৌড় মারলাম ওদের দিকে। ফিনিশিং লাইন থেকে ঈগলটনের গেট প্রায় পাঁচশো মিটার। সেখানে পৌঁছবার আগেই দেখা টিমের সঙ্গে। ফিনিশিং লাইনের দেখা পেয়ে তাদের গায়ে বাড়তি জোর এসে গেছে, আস্তাবলমুখো ঘোড়ার মত। জয়ের হাসিতে মুখ ঝলমল করছে সবার। সত্যি, এত প্র্যাকটিস, এত কসরৎ, এত কষ্ট — সবার ফল পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত! অবশেষে দেখা যায় দিল্লী! অনুভূতিটা বলে বোঝানো শক্ত। অনেক পড়াশুনো করে পরীক্ষা দিয়েও পাশ করা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হতে পারলামনা। কিন্তু দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর রেজাল্টে পাশের তালিকাতে নামটা দেখতে পেলে মনে যে অনুভূতিটা জাগে অনেকটা তার সঙ্গে তুলনীয়।

দূর থেকে ঢাকের বাদ্যি শোনা যাচ্ছিল। আমি আর পুষ্পরাজ তার তালে তালে নাচতে লাগলাম। আমাদের দেখে পায়ের ব্যথা ক্লান্তি সব ভুলে টিমের সবাই শুরু করে দিল উদ্দাম নাচ। সে কি নাচ! তার কাছে পুজো প্যান্ডেলের ধুনুচি নাচও হার মেনে যাবে। নাচতে নাচতে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করতে করতে, পৌঁছলাম ফিনিশিং পয়েন্টে, আরেক প্রস্থ অভ্যর্থনার মধ্যে। ঘড়িতে তখন বাজছে দু’টো বেজে বত্রিশ মিনিট। মানে ঠিক সাড়ে বত্রিশ ঘন্টায় একশো কিলোমিটার হেঁটে পার হয়েছে আমাদের টিম! ক্রম অনুযায়ী সত্তরের ঘরে আমাদের টিম।

তিরিশ ঘন্টার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক পূর্ণ হলনা। তা ক্ষতি নেই। সবাই যে অক্ষত শরীরে একশো কিলোমিটার পার করেছে, বিন্দুমাত্র চিটিং না করে, তাই বা কম কী? এদেরই না তিন মাস আগে হাঁটতে হবে শুনলে গায়ে জ্বর আসত? আমাদের আগে অনেক টিম শেষ করেছে, কিন্তু তাতেই বা কী? দুশো টিমের মধ্যে সত্তর নম্বর — সেটাই কি খারাপ? আমাদের প্রত্যাশা কম, তাই প্রাপ্তির আনন্দটা বেশি।

দীর্ঘ পথের শেষ!

দীর্ঘ পথের শেষ!

তারপর? তারপর আর কী? মেডেল আর সার্টিফিকেট নেওয়া হল। কোনরকমে ট্র্যাফিক ঠেলে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরে দু’টো মুখে গুঁজে শ্রীমতী সেই যে ঘুম লাগালেন, উঠলেন পরদিন সকালে। পায়ের ব্যথা ছিল প্রায় সপ্তাহখানেক!

পরিশিষ্টঃ ক্রম অনুযায়ী আমাদের টিম ছিল সত্তর নম্বর। কিন্তু চিটিং ধরা পড়ে যাওয়ায় অনেক টিমই শেষ পর্যন্ত বাদ পড়েছিল। আমাদের রাঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় তিপ্পান্ন। ডোনেশন জোগাড় করা হয়েছে প্রায় চুরাশি হাজার টাকার মত, দেশ বিদেশ থেকে। কেউ যদি চ্যারিটিতে টাকা দিতে চান, তবে আমাদের টিমের ডোনেশন সাইটে যেতে পারেন, লিঙ্ক দিয়ে দিলাম। 🙂

Leave a comment