এটা গুরুচন্ডা৯-তে লেখা একটা টই থেকে কপি-পেস্ট করা। আলোচনা প্রশ্নোত্তর পর্বগুলো বাদ দিয়েছি। শুধু আমার জ্ঞানদানটাই তুলে ধরলাম এখানে। টেকনিকাল কচকচিতে ভর্তি, তাই নেহাৎ মোটরবাইকে লাদাখ ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান না থাকলে এটা পড়ার প্রয়োজন নেই। টই-তে হারিয়ে যাবে বলে এখানে তুলে রেখে অমরত্ব প্রদান করলাম। 🙂
Tag Archives: Motorbike
জুলে! — ৭
[ জুলে! — ১ ]
[ জুলে! — ২ ]
[ জুলে! — ৩ ]
[ জুলে! — ৪ ]
[ জুলে! — ৫ ]
[ জুলে! — ৬ ]
আমাদের লাদাখ ভ্রমণের সপ্তকান্ড রামায়ণের ইতি টানছি এই পর্বে।
।। ৭-৮ জুলাই — প্রত্যাবর্তন ।।
প্যাঙ্গং সো থেকে ফেরার পর আরো দিন দুয়েক আমরা ছিলাম লেহ-তে। উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। বাইকদুটো ফেরত দিয়েছি। বাইকওয়ালা তার দুই পাড়ার দাদাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল লেহ-তে, বাইক নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাজারের কাছে একটা গলিতে দেখা করে বাইক হস্তান্তর করলাম। বিস্তর চোখা চোখা কথা আর বেঁকা হাসি সহ্য করতে হল, কিন্তু কী আর করা? পাঁকে যখন পড়েছি, তখন দু একটা চামচিকের লাথি সহ্য করা ছাড়া তো গতি নেই। আক্কেল সেলামিও দিতে হল একগাদা। আমাদের সফরের খরচা বেড়ে গেল একলাফে অনেকটা। এটাও মুখ বুজে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। পাড়ার দাদা দুটির চেহারা দেখে বুকে খুব একটা বল ভরসা জাগেনা। বেমক্কা পাঙ্গা নিয়ে নিলে ছোরাছুরি বার করাটা তাদের পক্ষে মোটেই অসম্ভব বলে মনে হলনা। গচ্চাটা দিয়ে মানে মানে সটকে পড়লাম আমরা।
এ ছাড়া একটা গাড়িতে কয়েকজনের সঙ্গে শেয়ারে গিয়ে খার্দুং-লা ঘুরে এলাম। বেজায় বরফ আর ততোধিক ঠান্ডা। জীবনে প্রথমবার নিজের চোখে ‘আইসিকল’ দেখলাম খার্দুং-লা তে। কিন্তু এ গল্পের বিশদে যাচ্ছিনা।
জুলে! — ৬
[ জুলে! — ৫ ]
।। ৩রা-৪থা জুলাই — প্যাঙ্গং সো ।।
পরদিন সকালে ন’টা নাগাদ আমরা আবার রওনা দিলাম। বাইকওয়ালা ইতিমধ্যে কিছু জানায়নি, কাজেই বাইক দুটো আরো দিন দুয়েক আমরা রাখতে পারব। এবারের গন্তব্যস্থল লাদাখের অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য, প্যাঙ্গং সো। মালপত্র সবই মোটামুটি গেস্ট হাউসেই রেখে এসেছি। সঙ্গে শুধু দুদিন চালানোর মতো জামাকাপড় আর বাইকের যন্ত্রপাতি।
সো শব্দের অর্থ হ্রদ। প্যাঙ্গং একটি সুবিশাল নোনা জলের হ্রদ। লম্বায় প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। চওড়া অবশ্য খুব একটা বেশি নয়, সব থেকে চওড়া অংশ আন্দাজ পাঁচ কিলোমিটার । হ্রদের অধিকাংশটাই (প্রায় ৯০ কিলোমিটার) চীনের মধ্যে পড়ে। লেহ থেকে প্রায় ঘন্টা পাঁচেকের রাস্তা, সঠিক দূরত্বটা ভুলে গেছি। উপশী হাইওয়ে ধরে শে ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে কারু বলে একটা জায়গা পড়ে, সেখান থেকে বাঁ দিকে ঘুরতে হয়। এরপর মাঠের মধ্যে দিয়ে এঁকা বেঁকা সরু পথ। রাস্তার অবস্থা খুবই ভাল, খানা খোঁদল চোখে পড়েনা বললেই চলে। মাঠ আবার সমতল নয়, উঁচু নিচু ঢেউ খেলানো। সেই ঢেউয়ের মাঝে রাস্তা যায় হারিয়ে। কোন দিকে যে সে চলেছে, দূর থেকে বোঝার উপায় নেই। মনে হয় এরপর বুঝি আর রাস্তাই নেই। এদিকটাতে প্রচুর গাছ গাছালি, ক্ষেত খামার আছে। চারিদিক সবুজে সবুজ। সেই ঢেউ খেলানো প্যাঁচালো রাস্তা দিয়ে আমরা দুলকি চালে চারিদিকের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চললাম।
জুলে! — ৫
আবার ফিরে এলাম লাদাখের ভ্রমণকাহিনিতে। এর আগের পর্বটা পাবেন এখানে।
|| কাপুরুষের আত্মোপলব্ধি ||
এই লেখাটার প্রথম পর্ব, অর্থাৎ আমাদের লেহ পৌঁছনোর গল্প, শেষ করতে না করতেই খবর পাই লাদাখের ভয়ঙ্কর বন্যা আর ধ্বসের। টিভি, ইন্টারনেট ও খবরের কাগজে সেই রক্ত হিম করা ছবি আর বর্ণনা দেখে মন বিকল হয়ে উঠল। লিখতে আর মন চায় না। মাত্র এক মাস আগেই তো আমি ওখানে ছিলাম! এই বন্যা বা ধ্বস তখন একেবারে অকল্পনীয় ছিল। মরুভূমিতে বন্যা হবে, এটা আর কে কবে ভেবেছে? ওখানকার অধিকাংশ বাড়িঘর মাটির তৈরি — বৃষ্টির ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা তাদের নেই। সেই ছবির মত লেহ শহর, চোগলুমসর গ্রাম, বাস স্টান্ড, লেহ-র বিখ্যাত তোরণ, সব ধ্বংস হয়ে গেছে শুনে কেমন অবিশ্বাস্য লাগে। সব থেকে যে জিনিসটা মনকে বিকল করে দেয় তা হল লাদাখের মানুষের এই ভাগ্যবিপর্যয়। আপাদমস্তক সৎ, ভদ্র, বিনয়ী, অতিথিবৎসল সর্বাঙ্গসুন্দর এই মানুষগুলির কপালে কি এই লেখা ছিল? শীত পড়তে আর বড়জোর দুটো মাস। তার মধ্যে যদি নতুন বাড়ি তৈরি না হয়, পুনর্বাসন যদি সম্পূর্ণ না হয়, তবে এই ঘরছাড়াদের কি হবে? ভেবেই শিউরে শিউরে উঠছি। তার ওপর আবার ভিন রাজ্য থেকে আসা BROর শ্রমিকরা দলে দলে পালাচ্ছে বলে শুনলাম। আশ্চর্য কিছুই নয়, সবাই চায় প্রাণ বাঁচাতে । কিন্ত ওরা চলে গেলে নতুন বাড়িই বা তৈরি করবে কে?
জুলে! — ৪
এই ভ্রমণকাহিনির তিনটে কিস্তি আগে পোস্ট করেছি। লিঙ্ক গুলো দিলাম — প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় কিস্তি।
।। ১লা জুলাই — সারচু থেকে লেহ ।।
সেদিন রাত্রে ভাল ঘুম হলনা, কিন্তু বাঁচোয়া যে মাথাব্যথা হয়নি। তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে দেখি চারদিক রোদে ঝলমল করছে। চারপাশের পাহাড়ের সারি নানা রঙে সেজে উঠেছে। সত্যি, পাথরের যে এত বিচিত্র রঙ হতে পারে, বা এত ঊষর প্রকৃতি যে এত নয়নাভিরাম হতে পারে, সেটা এই লাদাখ যাত্রা না করলে কোনদিন স্বচক্ষে দেখা হত না। যে ছেলেগুলোর সঙ্গে কাল এখানে এসেছিলাম, তাদের একজনের অবস্থা বেশ খারাপ, mountain sickness এর শিকার হয়েছে। ওরা তাড়াহুড়ো করে ভোর ভোর বেরিয়ে গেল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লেহ পৌঁছতে চায়।

সারচুতে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি ক্যাম্পের পাশের ছোট নালাটার জল জমে বরফ হয়ে রয়েছে। সূর্যের আলো ঝিকমিক করছে সেই বরফের ওপর পড়ে।
জুতোর অবস্থা কাল যা ছিল তার থেকে কিছুমাত্র উন্নতি হয়েছে বলে মনে হলনা। ভিজে এখনো একসা। কাল ঘন্টা তিনেক হয়ত ভিজে জুতো পরে ছিলাম। নিউমোনিয়ায় ধরেনি, সে আমাদের ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষের সৌভাগ্য। কিন্ত বেড়ালের ভাগ্যে বার বার শিকে ছেঁড়েনা। আজও সারাদিন ওই জুতো পরে থাকলে নিউমোনিয়ার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা। তাছাড়া আজও যে রাস্তায় জুতো ভিজবেনা, তার নিশ্চয়তা কি? মনে হল, জুতোর জায়গায় রবারের গামবুট পরে আসলে ভাল হত। ভিজে যাওয়ার ভয় থাকতনা। নির্ভয়ে নদী-নালা পেরোন যেত। সমস্যার বেশ মোক্ষম সমাধান বার করা হল — মোজার ওপর প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট বেঁধে, তার ওপর জুতো পরা। বরাতজোরে সঙ্গে কয়েকটা বাড়তি প্ল্যাস্টিক ছিল। আমি আবার প্যাকেট গুলো রেনকোটের প্যান্টের ওপর দিয়ে বেঁধে দিলাম, যাতে ওপর থেকেও জল ঢুকতে না পারে। দুপায়ের প্ল্যাস্টিকের রঙ দুরকম!
জুলে! — ৩
মোটরবাইকে লাদাখ ভ্রমণের দুটো কিস্তি আগেই পোস্ট করেছি — প্রথম আর দ্বিতীয় কিস্তির লিঙ্ক দিলাম। না পড়ে থাকলে চট করে পড়ে নিন! 🙂
।। ৩০শে জুন — ভয়ঙ্কর বারালাচা-লা ।।
পরদিন গড়িমসি করতে করতে বেরোলাম ন’টা নাগাদ। দেরি করার একটা কারণও ছিল — আগের দিন মেকানিক খঁুজে পাইনি, আজ সকালে গ্যারাজ খুললে জয়ের বাইকটা চেক-আপ করে তারপর বেরোব। বাইক চেক-আপ করে কিছু পাওয়া গেলনা । ইঞ্জিন অয়েল প্রয়োজনের চেয়ে কিছুটা বেশি আছে। ভাবনার কিছু নেই ভেবে আমরা বেরিয়ে পড়লাম । পিঠের বোঁচকাটা আজকেও রয়েছে, তবে অনেক হাল্কা। ক্যামেরা আর জলের বোতল ছাড়া তাতে আর কিছু নেই।
এ দিনটা আমাদের কপালে একের পর এক দুর্ভোগ ছিল। কিছুদূর গিয়েই সেই ভোগান্তির প্রথম পর্ব শুরু হল। রাস্তা কালকের মতই — বেশিরভাগটাই ভাঙাচোরা, কখন কখন একটু ভাল রাস্তার মুখ দেখা যায়। ভাগা নদী চলেছে কাছে কাছেই। বেশ কয়েকবার তার দেখা পেলাম। কয়েকবার নদীর ওপর দিয়ে ব্রীজও পেরোতে হল। দুপাশে একেবারে খাড়া পাহাড়, আর তার গা বেয়ে পাথরের ঢল। রাস্তার ওপর দিয়ে ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে একটু পরে পরেই। সৌভাগ্যক্রমে জুতো না ভিজিয়ে পার করলাম প্রথম কয়েকটা। তারপরই জয়ের বাইক ফুটফাট ভুটভাট শব্দে প্রবল প্রতিবাদ জানাতে লাগল। এগোতে তার মহা আপত্তি। এই ফুটফাট শব্দটাকে ইংরিজিতে engine splutter বলে। ইঞ্জিনে পেট্রল বা হাওয়া কম গেলে এই শব্দ হয়। প্রথম সন্দেহ হল যে তেল ঠিকঠাক বইছে না। পাইপ খুলে ভালভাবে পরিষ্কার করা হল। কোথাও air bubble আছে কিনা দেখলাম — নেই। হাওয়া বন্ধ হওয়ার কথাটা, কেন জানিনা, দুজনেরই মাথায় এলনা। নয়ত air filter পরীক্ষা করতাম আর গলদটা ধরা পড়ত। তখনকার মত সমস্যাটা মিটল বলেই মনে হল, কারণ বাইক ফুটফাট ছেড়ে স্বাভাবিক ভটভট আওয়াজ শুরু করল। ফের যাত্রা শুরু।
জুলে! — ২
আগের পোস্টে লাদাখ ভ্রমণের গল্প শুরু করেছিলাম। এটা তারই দ্বিতীয় কিস্তি। প্রথম কিস্তিটা না পড়ে থাকলে চট করে পড়ে নিন! 🙂
।।২৯শে জুন — মানালি থেকে কেলং।।
গল্প আরো এগোনোর আগে, আমাদের যাত্রাপথ, অর্থাৎ মানালি-লেহ হাইওয়ে সম্বন্ধে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য বলে রাখা ভাল। স্বাধীনতার সময়ও ভারতের কোন জায়গা থেকে লেহ যাবার একটাই রাস্তা ছিল, শ্রীনগর-লেহ হাইওয়ে। খুব সম্ভব ১৯৬২র চীন যুদ্ধের পর (সঠিক বলতে পারবনা, তবে সে রকমই শুনেছি), লেহ যাবার এই দ্বিতীয় রাস্তা, মানালি-লেহ হাইওয়ে, তৈরি হয়। কারগিল যুদ্ধের সময় থেকে সেনাবাহিনীর কাছে এই রাস্তার গুরুত্ব অত্যন্ত বেড়ে গেছে। ভবিষ্যতে এই রাস্তা জাতীয় সড়ক ২১-এর অংশ হবে বলে শোনা যায়, কিন্ত এখন এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে সীমা সড়ক সংগঠন (Border Roads Organization বা BRO), NHAI নয়। মানালি থেকে লেহ-র দূরত্ব ৪৯০ কিলোমিটার। রাস্তার প্রায় পুরোটাই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অন্ততঃ ১২০০০ ফুট ওপরে। বছরের অধিকাংশ সময় বরফ পড়ে বন্ধ থাকে। যাতায়াতের উপযোগী হয় মোটামুটি জুন মাসের গোড়া থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কোন কোন বছর বরফ কম পড়লে মে মাসেও খুলে যায় রাস্তা।
স্থায়ী জনবসতি এ রাস্তায় প্রায় নেই বললেই চলে। কেলং-এই (মানালি থেকে আন্দাজ ১২০ কিলোমিটার) শেষ পাকা বাড়ি ঘর দেখা যায় । তারপর থেকে সব তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী বসতি। আবার প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পর, তাংলাংলা পাস পেরিয়ে রুমৎসে-তে স্থায়ী গ্রামের দেখা পাবেন। মানালির পর ও লেহ-র আগে প্রথম ও শেষ পেট্রল পাম্প টান্ডিতে, কেলং-এর ১০ কিলোমিটার আগে। এই কারণেই আমরা (এবং এ রাস্তায় যারা পাড়ি জমায় তারা সবাই) ক্যানে করে বাড়তি পেট্রল সঙ্গে নিয়েছিলাম — একবার তেল ভরে পাহাড়ী রাস্তায় ৪৫০ কিলোমিটার বাইক নাও চলতে পারে। গাড়ি বা বাসে করে গেলে এই রাস্তা দুদিন বা দেড় দিনে পার করা যায়। মোটোরবাইকে গেলে, অন্ততঃ যারা প্রথম বার যাচ্ছে, তিন দিনে যাওয়া ভাল। এর কারণ শুধু যে এক দিনে বেশি দূর যেতে না হয়, তা নয়। আসলে প্রধান কারণ, উচ্চতা এবং বাতাসে কম অক্সিজেন — এই দুইয়ের সঙ্গে শরীরকে খাপ খাওয়ানোর সুযোগ দেওয়া। কম অক্সিজেনের মধ্যে থাকার অভ্যাস না থাকলে মানুষ acute mountain sickness এর শিকার হয় — অসহ্য মাথাযন্ত্রণা, বমি ভাব, ইত্যাদি এই রোগের লক্ষণ। এবং এই রোগের কোন ওষুধ নেই — একবার হলে সমতলে (বা অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায়) নেমে আসা ছাড়া দ্বিতীয় পন্থা নেই। Diamox বলে একটা ওষুধ আছে, যেটা রক্তের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। পাহাড়ে ওঠার কয়েকদিন আগে থেকে ওষুধটা খেলে রোগের সম্ভাবনা কমে যায়। কিন্তু একবার রোগ হলে এই ওষুধ কাজে দেয় না। গাড়ি বা বাসের যাত্রীেক এ রোগে ধরলে কিছুটা ভোগান্তি ছাড়া আর কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। ড্রাইভারের হলে অবশ্য আলাদা কথা। কিন্তু কল্পনা করুন, অসহ্য মাথাব্যথা নিয়ে, বরফ ঢাকা পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মোটোরবাইক চালাচ্ছেন। পপাত চ, এবং সেইসঙ্গে মমার চ হওয়া প্রায় অবশ্যম্ভাবী! তাই রয়ে সয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
জুলে! – ১
ভূমিকাঃ এই ভ্রমণকাহিনিটি লিখেছিলাম প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে, ২০১০ সালের জুলাই-অগাস্ট মাসে। করছি করব করে আর কোথাও পোস্ট করা হয়নি। এতদিন বাক্স, থুড়ি কম্পিউটার-বন্দী হয়েই পড়েছিল। এখন নিয়মিত ব্লগিং শুরু করায় ভাবলাম এটাকে এবার ধুলো টুলো ঝেড়ে বার করা যাক। ঘটনাক্রম ২০১০ সালের জুন-জুলাই মাস, লাদাখে সেই ভয়ঙ্কর বন্যা হবার মাত্র এক মাস আগে। মোটরবাইকে লাদাখ ভ্রমণ এখন অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেটে ছড়ানো রয়েছে ভূরি ভূরি travelogue। তিন বছর আগে এতটা জলভাত হয়নি ব্যাপারটা। ইন্টারনেট ঘেঁটে পুরো প্ল্যানটা তৈরি করতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল সে সময়।
জুলে! – ১
(জুলে শব্দটি লাদাখি ভাষায়। লাদাখের রাস্তা ঘাটে, গ্রামে গঞ্জে এই শব্দটিই সব থেকে বেশি কানে আসে। সুপ্রভাত থেকে শুরু করে শুভরাত্রি বা ধন্যবাদ, সব অর্থেই ব্যবহৃত হয় শব্দটি। এ বছর লাদাখ ঘুরে আসার পর মনে হল যে এত বিচিত্র ঘটনাবহুল এই অভিজ্ঞতা, এটা লিপিবদ্ধ না করা অবধি শান্তি হবেনা। বুক ঠুকে বসে গেলাম কলম হাতে।)
।। প্রস্তুতি পর্ব ।।
লাদাখে ঘুরতে যাবার শখ আমার বহুদিনের। কার্যগতিকে এতদিন হয়ে ওঠেনি। অফিসে ছুটি পাওয়া যায় না, বা বাড়িতে কাজ এসে পড়ে, বা সঙ্গী যোগাড় হয় না — এই করে প্রত্যেক বছর পিছিয়ে যেতে থাকে। তার ওপর আবার বছরের সব সময় লাদাখে যাওয়া যায় না, বা গিয়েও লাভ হয় না। বছরের ছ-মাস পুরো লাদাখ চাপা পড়ে থাকে বরফের তলায়। তখন ঘোরাঘুরি অসম্ভব। মে থেকে সেপ্টেম্বর — এই ক’মাসের মধ্যেই ঘুরতে হয়। এ বছর প্রায় আদা জল খেয়ে প্রস্তুতিতে লেগেছিলাম। প্ল্যান হল, মোটোরবাইকে চড়ে লাদাখ ভ্রমণ। হিমাচল প্রদেশের মানালি থেকে শুরু করে লাদাখ অঞ্চলের প্রধান শহর লেহ পৌছনো, তারপর লেহ-কে কেন্দ্র করে বাকি লাদাখ ঘুরে আবার মানালি ফেরা। মানালি-লেহ হাইওয়ে বিশ্বের কঠিনতম (দাবিটি অবশ্যই বিতর্কিত) মোটোরবাইকের রাস্তা (motorbike trail) বলে খ্যাত। পাঁচটি high altitude mountain pass পেরিয়ে লেহ পৌঁছতে হয়, তার মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম গাড়ি চলার রাস্তা (এই দাবিও বিতর্কিত), তাংলাংলা-ও পড়ে। তাংলাংলার উচ্চতা ৫৩৫৯ মিটার, বা ১৭,৫৮২ ফুট। এই রাস্তায় মোটোরবাইক চালানো আমাদের দলের সকলেরই স্বপ্ন।
প্রথম প্রশ্ন — মোটোরবাইক। নিজেদের বাইক নিয়ে যাব, না ভাড়া করব মানালি বা দিল্লী থেকে ? নিজেদের বাইক ট্রেনে চাপিয়ে দিল্লী নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, বা দিল্লী থেকে ভাড়াও নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু জুন মাসের গরমে দিল্লী থেকে মানালি বাইক চালিয়ে যাবার প্রশ্নে আমাদের গায়ে জ্বর এলো। তাছাড়া, এতে যাতায়াত মিলিয়ে অন্তত চারটে দিন বাজে নষ্ট, আর সময় জিনিসটা দুর্মূল্য। সুতরাং ঠিক হল, দিল্লী থেকে বাসে করে মানালি পৌঁছে সেখান থেকে বাইক ভাড়া। এই সিদ্ধান্তটা যে কতখানি ভুল ছিল এটা তখন বুঝিনি। পরে হাড়ে হাড়ে মালুম পেয়েছিলাম।