চরৈবেতি! — ১

।। ভূমিকা ।।

এর আগে একটি পোস্টে উল্লেখ করেছিলাম যে শ্রীমতী ভেতোবাঙালি একটা বিরাট ইভেন্টে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি হিসেবে ভয়ঙ্কর ফিটনেস রেজিম চালু করেছেন। সেই দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে আদাজল খেয়ে এক্সারসাইজ করতে লেগেছি। সেই বিরাট ইভেন্টটির সম্বন্ধেই বলতে চলেছি এই পোস্টে।

অক্সফ্যাম বলে বহুজাতিক NGO আছে। সংস্থাটি বেশ পুরোন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এদের উপস্থিতি। প্রধান উদ্দেশ্য দারিদ্র্য দূরীকরণ। এইসব NGO দের আমি চিরকাল কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখে থাকি। মনে হয় এগুলো সব শান্তিনিকেতনি ঝোলাধারী ‘কলচরড’ জনতার আড্ডা। আমাদের মত পাতি বুর্জোয়ারা সেখানে ব্রাত্য। এই অক্সফ্যাম সম্বন্ধেও নিন্দুকে বলে যে যত টাকা এরা জোগাড় করে, তার কুড়ি-তিরিশ শতাংশই চলে যায় নিজেদের পেট ভরাতে। তবে নিন্দুকে তো কত কথাই বলে। তাতে কান পাতলে চলবে?

অক্সফ্যামের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে যে এরা টাকা তোলার জন্য পৃথিবীর নানা দেশে ’ট্রেলওয়াকার’ বলে একটি ইভেন্টের আয়োজন করে। ভারতে হয় দু জায়গায় — মুম্বই আর বেঙ্গালুরু। এই ট্রেলওয়াকার শুরু হয়েছিল ১৯৮১ সালে, হংকং-এ — ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর গুর্খা রেজিমেন্টের জন্য। ইতিহাস চাইলে এই লিঙ্কে পড়ে নিতে পারেন। ইভেন্টের নিয়মকানুন মোটামুটি এরকমঃ

১) অংশগ্রহণ করতে চার জনের একটা দল গড়তে হবে।

২) চার জনের দলকে ইভেন্টের দুদিন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ১০০ কিলোমিটার হাঁটতে বা দৌড়তে হবে একটা নির্দিষ্ট পথে। পথ বলতে ম্যারাথন দৌড়ের ট্র্যাক নয়। মেঠো পথ, পাহাড়ি পাকদন্ডী, পিচের রাস্তা — সবই থাকে সে পথে। সাধারণতঃ গ্রাম-গঞ্জের ভেতর দিয়ে যায় সে রাস্তা — শহরে ঢোকেনা।

৩) সেই নির্দিষ্ট পথে ন’টা ‘চেকপয়েন্ট’ থাকবে — যেখানে খাবার, জল বিশ্রাম ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে। প্রত্যেকটা চেক পয়েন্টে দলের চারজনকে এক সঙ্গে ঢুকতে আর বেরোতে হবে। তার মানে এই দাঁড়ায় যে চারজনেরই হাঁটার বা দৌড়বার গতি মোটামুটি এক (বা অন্তত কাছাকাছি) হতে হবে।

৪) ৪৮ ঘন্টার মধ্যে চারজন এক সঙ্গে ১০০ কিলোমিটার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করলে মিলবে মেডেল আর শংসাপত্র।

শুনতে অতি সহজ, কাজের বেলা নয়। তবে সে কথায় পরে আসছি। প্রত্যেক টিমের একটা টাকা তোলার লক্ষ্যমাত্রা থাকে। ভারতে সেটা পঞ্চাশ হাজার টাকা। সে টাকা যায় চ্যারিটিতে, বা নিন্দুকের মতে ঝোলাওয়ালাদের পেটে। টাকাটা তুলতে হয় দলের সদস্যদেরই — বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজন পাড়া পড়শী সহকর্মী ইত্যাদির কাছ থেকে। অনলাইন ডোনেশনের ব্যবস্থা আছে, তাই দেশ বিদেশ থেকে টাকা জোগাড় করতে অসুবিধা হয় না। বহু বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি এই অক্সফ্যামের পৃষ্ঠপোষক। তারা মুক্তহস্তে দান করে থাকে। কোম্পানির কর্মীদেরও উৎসাহিত করে এই ট্রেলওয়াকারে অংশগ্রহণ করার জন্য। শ্রীমতী ভেতোবাঙালির সঙ্গে অক্সফ্যামের পরিচয় এই সূত্রেই।

যাঁরা ম্যারাথন দৌড়ে থাকেন, তাঁদের কাছে এই ট্রেলওয়াকার ব্যাপারটা খুব শক্ত কিছু নয়। একশোর বধ্যে চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার দৌড়েই পার করে দেন তাঁরা। বাকিটা হেঁটে। একটি টিম তো গত বছর তেরো ঘন্টায় একশো কিলোমিটার পার করেছিল। কিন্ত মজাটা হচ্ছে এই যে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই বহুজাতিক কোম্পানির ‘সারাদিন-ঠান্ডা-ঘরে-চেয়ারে-বসে-কাজ-করা’ কর্মী। সূর্যের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কম। দু’পা হাঁটতে গেলে গাড়ির প্রয়োজন পড়ে। এঁদের মধ্যে শ্রীমতীও আছেন। তিনি জম্মে কোনদিন এক কিলোমিটারের বেশি হেঁটেছেন কিনা সন্দেহ। চেহারাটা চিরকাল ছিপছিপে — তাই মেদ ঝরানোর জন্যও কখনো জিম-এ যাবার প্রয়োজন পড়েনি। মাসল্ মাস্ টেন্ডিং টু জিরো। এই তিনিই যখন উৎসাহের চোটে ট্রেলওয়াকারের জন্য নিজের নাম লিখিয়ে বসলেন, তখন মনে মনে প্রমাদ গুনলাম!

।। প্রস্তুতিপর্ব ।।

জাদুমন্ত্রই বলতে হবে। নয়ত শ্রীমতী যে ভানুমতীর খেল দেখানো শুরু করলেন, সেটা বিশ্বাস করা শক্ত। নিয়ম করে শুরু হল জিম-এ যাওয়া আর হাঁটা। চার-পাঁচ কিলোমিটার দিয়ে শুরু, তারপর আস্তে আস্তে বাড়ানো। ব্যাঙ্গালোরবাসী মাত্রেই জানেন যে পায়ে চলার পক্ষে এতটা অনুপযোগী শহর ভারতে বোধহয় আর দ্বিতীয়টি নেই। ফুটপাথ প্রায় নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে হাঁটার অযোগ্য। গাড়ির রাস্তায় হাঁটা ছাড়া গতি নেই। সে রাস্তাও সরু আর ভাঙা। তারপর গাড়ির ভিড় তো আছেই। ব্যাপারটা মোটামুটি ক্রস-কান্ট্রি রেস দৌড়নোর সামিল, আর প্রতি মুহূর্তেই প্রাণ হাতে করে চলতে হয়। কিন্তু একশো কিলোমিটারকে পাখির চোখের নিশানা বানিয়ে সেই রাস্তা দিয়েই শ্রীমতী হেঁটে চললেন, কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে। এদিকে সঙ্গে সঙ্গে চলল জিম-এ গিয়ে মাসল্ বিল্ড-আপ। প্র্যাকটিস চলল ব্যাঙ্গালোরের কাব্বন পার্ক আর আলসুর লেকের ধারে। এছাড়া ব্যাঙ্গালোরের কাছেই নন্দী হিল‍স্ বলে একটা ছোট পাহাড় আছে। চড়াই উৎরাই দিয়ে হাঁটা প্র্যাকটিস করার জন্য সেখানে গিয়ে ওঠানামা করা হল বেশ ক’দিন।

এর মধ্যে বেশ কিছু বিপত্তি। একদিন জিম-এ ঢুকবার মুখে হোঁচট লেগে একটা জ‍ব্বর আছাড় খেলেন শ্রীমতী। হাঁটুতে কালসিটে পড়ে বিশ্রী অবস্থা। আরেকদিন কি একটা কাজ করতে গিয়ে লাগল ঘাড়ে খ্যাচকা টান। আর ঘাড় নাড়তে পারেননা! কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা করে কে? ট্রেনিং বড়জোর দিন দুয়েক বন্ধ ছিল। তারপর আবার পুরোদমে চালু।

ব্যাপার স্যাপার দেখে আমার মুখ হাঁ। এবং ক্রমেই সে হাঁ-টা বিরাট থেকে বিরাটতর হয়ে উঠতে থাকল। এ কী অসম্ভব কান্ড? এই মানুষ যে আজ অবধি কোনদিন শারীরিক কসরৎ করেনি, সেটা আর বিশ্বাস করার জো নেই! মনে মনে অবশ্য অত্যন্ত খুশি না হয়ে পারলাম না। ‍চ্যারিটি মাথায় থাকুক, কিন্ত এই হুজুগে পড়ে যদি একটা খেলোয়াড়ি মনোভাব আর স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে ওঠে, তাই কি কম লাভ?

ট্রেলওয়াকারের ট্রেনিং-এর সম্বন্ধে অনেক উপদেশ ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। সেসব দেখে শুনে প্রস্তুতি চলল, প্ল্যান বানানো হল। সাজ সরঞ্জাম কেনা হল বেশ কিছু। রানিং শু, হাইড্রেশন প্যাক, টুপি, রেনকোট, মায় একটা হাইকিং-এর লাঠি। হাইড্রেশন প্যাক বস্তুটি বেশ মজার। দেখতে সাধারণ রুকস্যাকের মত, কিন্ত ভেতরে একটা ব্লাডার আছে যেটাতে জল বা এনার্জি ড্রিঙ্ক ভরা যায়। ব্লাডার থেকে লম্বা প্লাস্টিকের নল বেরিয়ে এসেছে। সেই নল মুখে দিয়ে চলতে চলতেই বেশ জল খাওয়া যায়। ব্যাগ খুলে বোতল বার করার আর প্রয়োজন পড়েনা।

এদিকে টিম তৈরি নিয়ে এক প্রস্থ হাঙ্গামা হয়ে গেল। টিমের তিনজন পাকা সদস্য পাওয়া গেল গোড়াতেই — শ্রীমতী আর দুজন সহকর্মী। কিন্তু চতুর্থ সদস্য জোগাড় করতে গিয়ে হল মুশকিল। এক জন প্রথমে রাজি হয়েও কিছুদিনের মধ্যেই ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। তার বদলে আরেকজন জোগাড় হল। সে প্র্যাকটিসও শুরু করল পুরোদমে। কিন্তু হঠাৎ বাড়িতে একটা কিছু অঘটন ঘটায় তাকে চলে যেতে হল ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে। এখন উপায়? ইভেন্টের আর কয়েকদিন মাত্র বাকি। মনে মনে ভাবলাম — এবার আমাকেই না নেমে পড়তে হয়! লেজে গোবরে হব তাতে সন্দেহ নেই, ঠ্যাং ভেঙে দ’ হওয়াটাও আশ্চর্য নয়, কিন্তু কি আর করা? শ্রীমতীর প্র্যাকটিস আর উৎসাহটাকে তো আর জলে যেতে দিতে পারিনা! তার জন্য যদি ঠ্যাং ভাঙে তো তাই সই। বরাতজোরই বলতে হ‍বে, শ্রীমতীর অফিসে হঠাৎ করে পাওয়া গেল আরেকজনকে। ভদ্রলোক প্রাক্তন সৈনিক, ম্যারাথন দৌড়েছেন আগে। এখনও যথেষ্ট ফিট। তাঁকেই বিস্তর তুতিয়ে পাতিয়ে রাজি করালেন শ্রীমতী। তিনিও বেশ উৎসাহের সঙ্গে প্র্যাকটিস শুরু করলেন।

চারজন সদস্য ছাড়াও প্রত্যেক টিমের একটা ‘সাপোর্ট ক্রু’ লাগে। এদের কাজ গাড়ি নিয়ে প্রত্যেকটা চেক পয়েন্টে যাওয়া। টিমের সদস্যদের জন্য খাবার দাবার জল ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। পায়ে মালিশ করতে সাহায্য করা। এছাড়াও আরো হাজারটা জিনিস লাগে — গ্লুকোজ, ওরাল রিহাইড্রেশন সল্যুশন (ORS), ক্রেপ ব্যান্ডেজ, নানারকম ওষুধপত্র। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য মাদুর, বালিশ, স্লিপিং ব্যাগ ইত্যাদি। লম্বা রাস্তা হাঁটা বা দৌড়নোর সময় ORS জিনিসটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । ঘামের সঙ্গে শরীরের জল আর ইলেকট্রোলাইট (মানে প্রধানতঃ সোডিয়াম) বেরিয়ে যেতে থাকে। মাংশপেশি সচল রাখার জন্য সোডিয়ামের দরকার। তাই শুধু জল খেলে চলেনা, সঙ্গে ইলেকট্রোলাইটও প্রয়োজন। ORS বা বিভিন্ন এনার্জি ড্রিঙ্ক এই ইলেকট্রোলাইটের ঘাটতিটা মেটায়। সাপোর্ট ক্রু বলতে আমি আর শ্রীমতীর জিম-এর ইন্সট্রাক্টর। শ্রীমতী বুদ্ধি খাটিয়ে এই ছেলেটিকে বলে রাজি করিয়েছিলেন অনেক দিন আগেই। ছেলেটি থাকাতে যে কী সুবিধে হয়েছিল ইভেন্টের সময়, তা আর বলার নয়। সে কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।

One thought on “চরৈবেতি! — ১

Leave a comment